শিবের গীত-রবীন্দ্রনাথ, নৌকা ও ধানের শীষ by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশে। সারা বছর ধরে রবীন্দ্র গবেষকেরা নতুন গবেষণার তাড়া অনুভব করবেন, অথবা পুরোনো গবেষণার তোড়া নতুন নামে সাজাবেন। এত বই আর সংকলন বের হচ্ছে এ বছর বিশ্বকবির ওপর যে সবচেয়ে অপ্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র-লেখককেও তিনখানা নিবন্ধ লিখতে হবে তাঁকে নিয়ে।


এসব গবেষণায় নতুন বিষয় কিছু না কিছু নিশ্চয় যুক্ত হবে, যেমন ‘রবীন্দ্রনাথ কেন মোগলাই পোশাক পরতেন?’ অথবা ‘রবীন্দ্র-সাহিত্যে মশা ও অন্যান্য পতঙ্গ’। আওয়ামী মহিলা তাঁতী লীগ যে সংকলন বের করবে, তাতে ‘বাংলাদেশের তাঁতশিল্প উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা’ অথবা ‘রবীন্দ্রনাথ ও হাসিনা সরকারের দুই বছর’ শীর্ষক প্রবন্ধ থাকতে পারে। থাকা উচিতও। তাঁর হাত ধরেই তো বাংলা সাহিত্যের বিশ্বদরবারে পৌঁছানো এবং তাঁর লেখা গানই তো এখন বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। তিনি নোবেল না পেলে এ বছর তাঁকে নিয়ে এত বই এত সংকলন কি বের হতো, আর লেখালেখি করে আমিও কি তিন হাজার টাকা উপার্জন করতে পারতাম? তাঁর প্রতি এই যে ঋণ, তা কি সহজে শোধ হয়?
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মহিলা তাঁতী লীগের সংকলনের কথা উল্লেখ করেছি, কিন্তু জাতীয়তাবাদী মহিলা তাঁতী দলের সংকলনের কথাটা তুলিনি—এ নিয়ে দেশের বিরোধী শিবির থেকে কেউ কেউ অভিযোগ তুলতে পারেন। কিন্তু অভিযোগের উত্তরটিও তাঁরা দিতে পারবেন, যেহেতু মহিলা তাঁতী দল, আমার জানামতে, তাঁকে নিয়ে কখনো কোনো উচ্ছ্বাস দেখায়নি। এ বছর যে দেখাবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বস্তুত খোদ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলেই কি কোনো উচ্ছ্বাস আছে? জনমনে বরং একটা ধারণা, দলটি রবীন্দ্রবিরোধী না হলেও রবীন্দ্র-নিরপেক্ষ। দলটির এক বড় নেতা, যিনি এখন কারান্তরালে সংগ্রামী জীবন অতিবাহিত করছেন, তিনি তো বলেই দিয়েছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের লেখা কোনো গান আমাদের জাতীয় সংগীত হতে পারে না।’ কিন্তু জাতীয়তাবাদী দল যতই দূরে রাখুক রবীন্দ্রনাথকে, তিনি তাদের মোটেও দূরে রাখেননি। তিনি আওয়ামী লীগকেও দূরে রাখেননি। রাখেননি যে তার প্রমাণও আমাদের কাছে আছে। এরশাদের পতনের পর একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ১০০ বছর আগে ‘আজি হতে শত বর্ষ পরে’ ধরনের চেতনা থেকে লেখা একটি কবিতায় তিনি বাংলাদেশের দুটি বড় দল নিয়ে একটি ঐতিহাসিক মূল্যায়ন করেছিলেন। মূল্যায়নটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য ১০০ বছর পরের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে এতটা দূরদৃষ্টি ও স্বচ্ছতা নিয়ে তাঁর দেখার জন্য।
এ কবিতাটি প্রমাণ করে ১. রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ বলতে বর্তমান বাংলাদেশকেই বুঝতেন, ২. বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তিনি আমাদের মতোই আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে দুলতেন এবং ৩. শেষ পর্যন্ত একটা হতাশা দিয়েই তাঁর বাংলাদেশের রাজনীতি-দর্শন শেষ হয়েছিল, আমাদের মতোই।
কবিতাটির নাম ‘সোনার তরী’।
কবিতাটির একটি সারাংশ করলে এ রকম দাঁড়ায়: কবিতার হা-হুতাশকারী উত্তম পুরুষ রাশি রাশি ধান কেটে কূলে বসে আছে, একটা নৌকা চালিয়ে কেউ একজন এল, তার সব ধান তুলে নিয়ে নৌকা বোঝাই করল এবং তাকে ফেলে রেখেই চলে গেল। বড়ই শূন্যতার কবিতা, আবার পূর্ণতারও। এত যে ভারা ভারা ধানের শীষ ওই উত্তম পুরুষ স্তূপ করে রাখলেন নদীর তীরে, তা তিনিই কিনা তুলে দিলেন নৌকায়। ভাবুন, নৌকা বোঝাই হচ্ছে ধানের শীষে! তারপর কিনা নৌকা হাওয়া। বক্ষ্যমাণ কবিতায় কবি বোঝাতে চেয়েছেন, জাতীয়তাবাদী দল ও আওয়ামী লীগ একটি জায়গায় এসে চমৎকার এক সহাবস্থান তৈরি করল, কিন্তু যে লোক নৌকা চালাচ্ছিল, সে দুটো নিয়েই হাওয়া হয়ে গেল। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী-আওয়ামী সৌহার্দ্য এক নিষ্ফলতায় শেষ হলো, যেখানে উত্তম পুরুষ (অর্থাৎ জনগণ) কিছুই পেল না। জনগণ ‘শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ে।’
কী আর করা!
রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ তাই আওয়ামী লীগের গল্প, জাতীয়তাবাদী দলের গল্প—এ দুই দলের একটি অবস্থানে একত্রে আসার গল্প, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণের হাত থেকে দুটি দল বেরিয়ে যাওয়ার এবং (সম্ভবত) দেশ হাইজ্যাক হয়ে যাওয়ার গল্প। যে লোকটি ধানের শীষ ও নৌকা নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল, সে কে? দলীয় টেন্ডারবাজ, সন্ত্রাসী? তৃতীয় শক্তি, যারা মাঝেমধ্যেই গণতন্ত্রকে হাওয়া করে দেয়? মাইনাস টুর প্রবক্তারা? নাকি কোনো পরাশক্তি? বোঝাই যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ সহজ মানুষ ছিলেন না, থাকলে কি আর এত বড় মাইনাস টুর ঘটনাটা তিনি ধরতে পারতেন?
রবীন্দ্রজন্মের সার্ধশত বছরে তাঁর ওপর লেখা আমার এই দ্বিতীয় প্রবন্ধের শিরোনাম হতে পারত ‘রবীন্দ্রনাথ ও মাইনাস টু’। হয়নি, কারণ ‘সোনার তরী’ দেখিয়েছে, ভুখা জনগণও মাইনাস হয় এবং তাদের খুশি রাখার জন্য আধ্যাত্মিক চিন্তার একটা থালা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। ‘সোনার তরী’ ও ‘অধ্যাত্ম চিন্তার থালা’ নামে এ বছর লিখিতব্য কোনো প্রবন্ধে সেই বিষয়টি নিশ্চয় পাওয়া যাবে। প্রবন্ধটি কেউ না লিখলে আমিই লিখব এবং সেটি হবে এ বছর আমার তৃতীয় ও শেষ রবীন্দ্র-প্রবন্ধ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.