দূর দেশ-পাকিস্তান: নতুন হিসাব-নিকাশ by আলী রীয়াজ

মালিক মুমতাজ কাদরি এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি; ৪ জানুয়ারির আগে যে নামটি প্রায় কারোরই জানা ছিল না, তা এখন সর্বত্র আলোচিত। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুমতাজ কাদরির নাম ও ছবি সহজেই চোখে পড়ছে। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানের ইসলামপন্থী কয়েকটি দল, ‘ওলামা’ বলে দাবিদার অনেক ব্যক্তি ও রাতারাতি তৈরি হওয়া সমর্থক গোষ্ঠীর সদস্যরা মুমতাজ কাদরিকে ‘আশেক-ই-রাসুল’ বলে বর্ণনা করছেন।


তাঁরা তাঁকে বর্ণনা করছেন ‘গাজি’ বলে। মুমতাজ কাদরির এই পরিচিতি ও খ্যাতির কারণ হলো, পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর সালমান তাসিরকে প্রকাশ্য দিবালোকে ঠান্ডা মাথায় তিনি হত্যা করেছেন। হত্যার দায় অস্বীকার করার বদলে তিনি দাবি করেছেন যে সালমান তাসিরকে হত্যা যথার্থ কাজ। কাদরির দায়িত্ব ছিল গভর্নরের দেহরক্ষী হিসেবে তাঁকে রক্ষা করা। তিনি বরং তাসিরের হত্যাকেই তাঁর দায়িত্ব বলে মনে করেছেন। কেননা, গভর্নর তাসির দেশের একটি বিতর্কিত ও বৈষম্যমূলক আইন—ব্লাসফেমি আইনের বিরোধিতা করে একে কালো আইন বলে বর্ণনা করেছিলেন। ওই আইনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন খ্রিষ্টান নারীর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন।
সালমান তাসিরের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। এই মৃত্যুর পর হত্যাকারী মুমতাজ কাদরিকে ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটছে, তার তাৎপর্য বোধকরি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার আকস্মিকতাকে ছাড়িয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ডের নায়ক মুমতাজ কাদরি সম্পর্কে এখন জানা যাচ্ছে যে তিনি আগেই এই হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। কাদরি অতীতে তাঁর দায়িত্ব থেকে অপসারিত হয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক মনোভাবের জন্য তিনি চরমপন্থী মনোভাব প্রদর্শনে দ্বিধান্বিত ছিলেন না। গভর্নরকে হত্যার পর কাদরিকে আটক করা হয়। দুই দিন পর কাদরিকে আদালতে হাজির করা হয় যে গাড়িতে করে, আদালত প্রাঙ্গণে তাঁর সমর্থকেরা তাতে ফুল ছিটিয়ে স্বাগত জানান।
ঘটনার শেষ এখানেই নয়, ইতিমধ্যেই মুমতাজ কাদরির সমর্থনে দেশের ইসলামপন্থীদের একাংশ সরব হয়ে উঠেছে। তারা প্রয়াত সালমান তাসিরের জন্য দোয়া না করার আহ্বান জানিয়েছে। যাঁরা তাঁর সমর্থন ও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছেন, তার মধ্যে আছেন সিন্ধু প্রদেশের জামায়াতে ইসলামির আমির আসাদুল্লাহ ভুট্টো, জামিয়া বিশেরিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদের মুফতি নাঈম, জমিয়াতে উলামায়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতা মওলানা সাব্বির ও দলের প্রধান আবুল খায়ের মুহাম্মদ জুবায়ের। এই তালিকাটি দীর্ঘ। কিন্তু এই তালিকায় রয়েছেন জামায়াতে আহলে সুন্নাতের সদস্য বা বারেলভি মতানুসারী ৫০০ ওলামা ও মওলানা। বারেলভি মতানুসারীদের সমর্থনের বিষয়টি সবার মনোযোগ দাবি করে এ কারণে যে তা পাকিস্তানে বিভিন্ন গোষ্ঠী বিষয়ে এত দিনের ধারণার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
সালমান তাসিরের হত্যা ও তাঁর হত্যাকারী মুমতাজ কাদরির এই ‘জনপ্রিয়তা’ বুঝতে হলে ব্লাসফেমি আইন ও প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা দরকার। পাকিস্তানে ‘ব্লাসফেমি আইন’ প্রচলন হয় সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউল হকের শাসনামলে। এই আইনের আওতায় কোরআন শরিফ ও হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর অবমাননার জন্য যেকোনো ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ড পর্যন্ত দেওয়ার বিধান রয়েছে। জিয়াউল হকের আমলেই এই আইনের বিরুদ্ধে দেশের সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দলসমূহ, মানবাধিকারকর্মী ও দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক সমাজ তীব্র প্রতিবাদ জানালেও প্রায় তিন দশক ধরে এই আইন বহাল রয়েছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানে বহুবার বেসামরিক নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসেছে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছেন সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফ, যিনি বিভিন্ন রকম সংস্কারের দাবিও করেছেন। পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় এ নিয়ে মৃদু আপত্তি করলেও ক্ষমতায় গিয়ে তারা কখনোই কোনো রকম পদক্ষেপ নেয়নি। এই আইনটি দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মাথার ওপরে খড়্গের মতো ঝুলে থাকে। এক হিসাব অনুযায়ী, ১৯৮৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৬৪৭ জনের বিরুদ্ধে এই আইনের আওতায় অভিযোগ আনা হয়। এর অর্ধেকই হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য। ভয়াবহ তথ্য হলো এই যে ১৯৯০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ৩৫ জন অভিযুক্ত হওয়ার পরপরই খুন হয়েছেন। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনেকেই সুবিচার লাভ করেননি, অধিকাংশই যাবজ্জীবন বা দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে কাটাচ্ছেন। অনেক, সম্ভবত অধিকাংশ অভিযুক্ত ব্যক্তিই দাবি করেছেন যে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই আইনের আওতায় আনা অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকায় যেমন রয়েছেন অশিক্ষিত মানুষ, তেমনি রয়েছেন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। পাকিস্তানের খবরাখবর যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেন, তাঁদের অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে যে ২০০০ সালে ইউনুস শেখ নামের একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তাঁর একজন ছাত্র অভিযোগ করে যে তিনি ক্লাসরুমে ইসলাম ও হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বিষয়ে আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছেন। আদালত ইউনুস শেখকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তিন বছর পর অপর একটি আদালত তাঁকে অব্যাহতি দিলে তিনি পালিয়ে ইউরোপে চলে যান। এই আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তিরাই যে কেবল দুর্ভোগের মুখোমুখি হয়েছেন তা নয়। আশরাফ মশিহ ও তাঁর স্ত্রী মার্যা মশিহ এই অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পর দরিদ্র গাড়িচালক আশরাফকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়। পুলিশ মার্যাকে ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের ঘটনা অসংখ্য। অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বছরের পর বছর কারাগারে থাকার পর আদালতের রায়ে ছাড়া পান। এ ধরনের রায় দেওয়ার জন্য বিচারকেরা বড় রকমের মাশুল গুনেছেন। ১৯৯৭ সালে লাহোরে আরিফ ইকবাল হোসেন ভাট্টি নামের একজন বিচারক ব্লাসফেমির অভিযোগ থেকে দুজনকে খালাস দেওয়ার পর তাঁর অফিস কক্ষে নিহত হন।
আশির দশক থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের শহরে ও প্রত্যন্ত গ্রামে ব্লাসফেমি আইনের শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছেন অনেকে। অনেকেই কারাগারে কাটাচ্ছেন। একমাত্র পাঞ্জাবেই ১৩১ জন এখন এ অভিযোগে আটক আছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের সুযোগ না দিয়ে হত্যা করে ফেলার ঘটনা গত বছরগুলোতে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১০ সালের জুলাই মাসে যাজক রশিদ ইম্মানুয়েল ও তাঁর ভাই সাজিদ ইম্মানুয়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন এক ব্যক্তি। এই দুই ভাইকে আটক করে আদালতে হাজির করার সময় ফয়সালাবাদের একটি আদালতের মধ্যেই বন্দুকধারীরা তাঁদের গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানের সংখ্যালঘুবিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টি এই দুজনকে পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের ‘ভিকটিম’ বলে বর্ণনা করলে তাঁর বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া হয়। অভিযোগ করা হয় যে তিনিও ব্লাসফেমির অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার যোগ্য।
ব্লাসফেমি আইনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত এসব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচারিত হলেও পাকিস্তানের বহুবিধ রাজনৈতিক সংকট, দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমানায় চলমান যুদ্ধের কারণে এগুলো অধিকাংশ মানুষেরই মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু গত বছর যখন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়তে থাকে, তখন অনেকেই এই আইনের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেন। তবে যে কারণে ব্লাসফেমি আইন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নেয়, তার কারণ আসিয়া বিবি।
পাঁচ সন্তানের জননী আসিয়া বিবি আটক হন ২০০৯ সালের জুন মাসে, পাঞ্জাবের একটি গ্রামে। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয় এবং বিচারাধীন অবস্থায় দেড় বছরের মতো কারাগারে আটক থাকেন তিনি। ২০১০ সালের নভেম্বর মাসের ৮ তারিখ আদালত রায় দেন যে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেশে ও বিদেশে বিতর্কের ঝড় তোলে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি তাঁকে অনুকম্পা প্রদর্শন করেন।
প্রেসিডেন্টের এই ক্ষমা প্রদর্শনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের কতিপয় ইসলামপন্থী দল ও মাদ্রাসাছাত্র বিক্ষোভ শুরু করে এই বলে যে জারদারির ক্ষমা প্রদর্শনের এখতিয়ার নেই। ডিসেম্বর মাসের গোড়ায় পাঞ্জাবের একটি আদালত রায় দেন যে যেহেতু রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিচারাধীন এবং যেহেতু হাইকোর্ট এখনো এই দণ্ডাদেশের বিষয়ে মতামত দেননি, সেহেতু প্রেসিডেন্টের এই ক্ষমা প্রদর্শন বৈধ নয়। অনেক ইসলামপন্থী রাজনীতিক বলেন, ব্লাসফেমি আইনে দণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তিরা ক্ষমার অযোগ্য। আদালতের দণ্ডাদেশের পর থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ বিষয়ে তাদের আপত্তির কথা জোরেশোরে বলে আসছে। আসিয়া বিবি যেহেতু প্রথম নারী, যিনি এই আইনের আওতায় মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন, সেহেতু এটি সর্বত্রই বেশ গুরুত্ব লাভ করে।
এই পটভূমিকায় পাকিস্তানের দুজন রাজনীতিবিদ সালমান তাসির ও শেরি রহমান প্রেসিডেন্ট জারদারির কাছে আবেদন জানান যেন ব্লাসফেমি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সালমান তাসির কেবল পাঞ্জাবের গভর্নরই নন, তিনি জারদারির ঘনিষ্ঠও বটে। গভর্নর তাসির আসিয়া বিবির পক্ষেও মন্তব্য করেন। অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠতে শুরু করেন যে সম্ভবত পাকিস্তান পিপলস পার্টি নতুন বছরে এই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেবে। এ রকম পরিস্থিতিতেই সালমান তাসিরকে হত্যা করা হলো। তাসির যে কেবল এই আইনেরই বিরোধী ছিলেন তা নয়, তিনি দেশের ভেতরে বেড়ে ওঠা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোরও ঘোর সমালোচক ছিলেন। পাকিস্তানের ভেতরে ও বাইরে অনেক বিশ্লেষক যখন জঙ্গিবাদ কেবল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সমস্যা বলে চিহ্নিত করতে চান, সালমান তাসির তখন জোর দিয়ে বলেছেন যে পাঞ্জাবে পাকিস্তানি তালেবানরা শক্ত ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেছে। গত বছরের জুন মাসে দৈনিক ডনে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছিল, সালমান তাসির বলেছেন, পাঞ্জাবি তালেবান এখন একটি বাস্তবতা।
আশা করি, পাঠকেরা বুঝতে পারছেন যে মালিক মুমতাজ কাদরি একা নন এবং সালমান তাসিরের হত্যাকাণ্ড কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর শক্তি ও প্রভাবের একটি উদাহরণ হচ্ছে মালিক মুমতাজ কাদরি ও এই হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ব্লাসফেমি আইনের বিরোধীদের একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে যে ১৯৯৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী জাতীয় সংসদে ব্লাসফেমি আইনের খসড়া উপস্থাপন করেছিলেন (এ বিষয়ে উৎসাহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন আমার সম্পাদিত বই ব্লাসফেমি আইন প্রসঙ্গে, অঙ্কুর প্রকাশনী, ১৯৯৫)। ওই আইন ছিল পাকিস্তানে প্রচলিত আইনের হুবহু অনুলিপি। ২০০৮ সালে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে তারা বিজয়ী হলে দেশে ব্লাসফেমি আইন চালু করা হবে।

২.
পাকিস্তানে সালমান তাসিরের হত্যাকারী মালিক মুমতাজ কাদরির সমর্থনে যাঁরা এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে বারেলভি ওলামারাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সরব। এ বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যথেষ্ট গুরুত্ব না পেলেও এর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী।
সুন্নি মতানুসারী মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণে বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এই মতাদর্শগত বিভক্তি তিনটি প্রধান ধারায় বিভক্ত—বারেলভি, দেওবন্দি ও আহলে হাদিস। বারেলভি ধারার উদ্ভব ঘটে ১৮৮০-এর দশকে। এই মতানুসারীদের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে আহমেদ রেজা খান বারেলভির (১৮৫৬-১৯২১) রচনাদি ও নেতৃত্ব। বারেলভি মতানুসারীরা ওই সময়ে সংগঠিত হন সংস্কারপন্থী দেওবন্দি ও আহলে হাদিস আন্দোলন মোকাবিলার জন্য। দেওবন্দ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংস্কারপন্থীরা তৎকালীন ভারতে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের আচার-আচরণের বিরোধিতা করেন। এর মধ্যে রয়েছে সুফি-সাধকদের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন। বারেলভিরা অন্যপক্ষে এ ধরনের আচার-ব্যবস্থার সমর্থন করেন। আহলে হাদিসরা তুলনামূলকভাবে অধিক কট্টর বলে বিবেচিত হন; কেননা তাঁরা একাদশ শতাব্দী থেকেই ইসলামি চিন্তাকে শুদ্ধিকরণের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন।
ইসলাম ও রাজনীতি বিষয়ের বিশ্লেষকেরা সব সময়ই বারেলভি গোষ্ঠীকে দেওবন্দি ও আহলে হাদিসের তুলনায় উদার বলে বিবেচনা করে এসেছেন। তার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণও তাঁরা হাজির করতে পেরেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেওবন্দি ও বারেলভিদের মধ্যে জোর বিতর্কের সময়ে বারেলভিরা ইসলামের সমন্বয়বাদী ধারার প্রতিই পক্ষপাত প্রদর্শন করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দেওবন্দিরা সমর্থন দেননি, অন্যদিকে বারেলভিরা তার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী দেওবন্দ অনুসারীদেরই সমর্থন জানিয়েছে। সংখ্যার দিক থেকে পাকিস্তানের অধিকাংশ সুন্নি মুসলমান বারেলভি মতাবলম্বী এবং তাদের শক্ত ঘাঁটি হচ্ছে পাঞ্জাব। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সমর্থনে পাকিস্তানের ভেতরে যে গোষ্ঠীটি সবচেয়ে বেশি শক্তি সঞ্চয় করে, তারা দেওবন্দি ধারার অনুসারী। অনেকে এই থেকে উপসংহারে পৌঁছান যে বারেলভি অনুসারীরা রাজনীতি ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে চান না।
পাকিস্তানে আশির দশক থেকে গোষ্ঠীগত সংঘাতের পথ ধরে যেসব জঙ্গি সংগঠন গড়ে উঠেছে, তার অধিকাংশই দেওবন্দি ও আহলে হাদিস ধারার। বারেলভিরা যে এই গোষ্ঠীগত সংঘাতে শরিক হননি তা নয়, তাদের সমর্থক জঙ্গিগোষ্ঠীও তৈরি হয়। কিন্তু গত ৩০ বছরের বেশি সময়ের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করে বিশ্লেষকেরা প্রায়ই বারেলভি মতানুসারীদের তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থী ও সহিষ্ণু বলে বর্ণনা করে এসেছেন। বারেলভি মতানুসারীদের সংগঠনগুলোর মধ্যে আটটি সংগঠন ২০০৯ সালে সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিল গঠন করে দেশের ‘তালেবানীকরণ’ মোকাবিলার ডাক দেয়।
বারেলভি মতানুসারীদের এই অবস্থান এবং দীর্ঘ ইতিহাস তাদের চরমপন্থা-বিরোধী বলে পরিচিত করে রেখেছিল, কিন্তু সালমান তাসিরের হত্যাকাণ্ডের পর তাদের সর্ববৃহৎ সংগঠন জামায়াতে আহলে সুন্নাত পাকিস্তানের সদস্য ৫০০ ওলামার বিবৃতি বিস্ময়কর বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। তাঁরা মুসলমানদের তাসিরের জানাজায় যোগ না দেওয়ার আহ্বান জানান, এমনকি তাসিরের জন্য দোয়া না করতেও বলেন। এসব থেকে স্পষ্ট যে পাকিস্তানের বারেলভি ওলামাদের একটা বড় অংশের মধ্যেই চরমপন্থী মনোভাব জোরদার হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের গোষ্ঠীগত রাজনৈতিক পরিবেশে এই নতুন পরিস্থিতি কারও জন্যই সুসংবাদ বয়ে আনছে না।
পাকিস্তান বিষয়ে যাঁরা উৎসাহী, তাঁরা যেমন চলমান ঘটনাবলির ওপর নজর রাখছেন; ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, তারাও আশা করি একইভাবে এই নতুন পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নেবেন।
ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.