কালের পুরাণ-আওয়ামী লীগের ভোটে ভাটার টান by সোহরাব হাসান

ভোটাররা আবারও প্রমাণ করলেন, তাঁরাই সার্বভৌম, কোনো দলের বন্ধকি সম্পত্তি নন। দেশের সাতটি বিভাগের মধ্যে গত সপ্তাহে যে চারটি বিভাগের ১২১টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তাতে যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার দোসর জাতীয় পার্টি যে সন্দেহাতীতভাবে খারাপ করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।


কেন এমনটি হলো? দলের নেতারা বলার চেষ্টা করছেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিদ্রোহী প্রার্থীরাই এর জন্য দায়ী। এটি অর্ধসত্য মাত্র। পুরো সত্য হলো, ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের প্রতি পিঠ ফেরাতে শুরু করেছেন। দুই বছর আগে যে আশা নিয়ে ভোটাররা আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করেছিলেন, সেই আশা সামান্যই পূরণ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন উল্টো দিকে বইতে শুরু করেছে। এর প্রধান কারণ আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী-ক্যাডারদের বাড়াবাড়ি।
ঢাকায় আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা ফজলুল হক নিহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন আইনশৃঙ্খলা ‘কিঞ্চিৎ’ অবনতি হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। তাঁর লাশ দেখতে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছেন, এর পেছনে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলেও আভাস দিয়েছেন তিনি। দায়িত্বে অবহেলার জন্য একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু কয়েক মাস আগে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূরের মৃত্যুর পর তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া আমরা পত্রিকায় পড়িনি। নূর হত্যার ঘটনা ঘটেছে দিনের বেলায়, বহু মানুষের সামনে। তাঁর হত্যার দৃশ্য ভিডিওতেও ধারণ করার পরও মূল আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। দুই ক্ষেত্রে সরকারের বিপরীত প্রতিক্রিয়া কি পৌরসভা নির্বাচনে প্রভাব ফেলেনি? নিশ্চয়ই ফেলেছে। আইন সবার জন্যই সমান হবে। আওয়ামী লীগ নেতা খুন হলে এক রকম, বিএনপির নেতা খুন হলে অন্য রকম, তা হতে পারে না।
ঢাকার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুল হক হত্যার পেছনে দলীয় কোন্দলই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। ওয়ার্ড সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিবাদ বহু পুরোনো। এর আগে ওয়ার্ড সভাপতি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। শুক্রবারের গুলি কি বদলা নেওয়া? এর আগে সাংসদের গাড়িতে নিহত হন আওয়ামী লীগের কর্মী ইব্রাহিম। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগের এই হত্যাকাণ্ড আমাদের ২০০১-০২ সালের ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয়। ওই সময় বিএনপির অন্তত চারজন কমিশনার খুন হয়েছিলেন প্রতিপক্ষের হাতে, তাঁরা নিজেরাও কোনো না কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
উত্তরাঞ্চলের দুটি বিভাগে বিএনপির সাফল্য প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দুর্গে তারা ভালোভাবেই আঘাত হানতে পেরেছে। এই নির্বাচনে আবারও প্রমাণিত হলো, এরশাদের সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। ভবিষ্যতে রংপুর আর জাতীয় পার্টির ঘাঁটি থাকছে না। সেখানকার ভোটাররা যে আঞ্চলিকতামুক্ত হতে পেরেছেন, এ জন্য তাঁদের মোবারকবাদ জানাই।
বাংলাদেশের আবহাওয়ার মতো ভোটাররা কোন দিকে ঝুঁকবেন বোঝা মুশকিল। তাঁরা উত্তম কিছু পাবেন না জেনেও বারবার ভোটকেন্দ্রে যান তাঁদের জন্য কাজ করবেন এমন প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে। কিন্তু সেই দরদি প্রার্থী কোথায় পাবেন তাঁরা? সারা দেশে তো মতিয়া চৌধুরী বা নুরুল ইসলাম নাহিদ নেই। সেই কারণে অপেক্ষাকৃত কম মন্দ প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়ী করেন। এভাবে একবার আওয়ামী লীগ, আরেকবার বিএনপির মনোনীত বা সমর্থকেরা নির্বাচিত হন। তারপর যেই লাউ সেই কদু। নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁরা ভাবেন, ‘আমরা সবাই রাজা এই রাজার রাজত্বে’। তখন ভোটাররা তক্কে তক্কে থাকেন এবং সুযোগ পেলেই তার জবাব দেন। তাঁদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই, ক্ষমতা নেই—একটি ভোট ছাড়া। তাঁরা তা প্রয়োগ করেন।
চারটি বিভাগে পৌর নির্বাচনে ভোটাররা যে রায় দিয়েছেন, তা আওয়ামী লীগের প্রতি হলুদ কার্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ প্রথম সতর্কবার্তা। এরপর তারা লালকার্ড পাবে, না পরবর্তী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য উইনার কার্ড পাবে, তা নির্ভর করবে আগামী তিন বছরে তাদের কাজ, কথা ও আচরণের ওপর।
সরকারের দুই বছর উপলক্ষে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যে জরিপ প্রকাশ করা হয়েছিল, সেই জরিপটি নীতিনির্ধারকেরা মনোযোগ দিয়ে পড়লে দেখতে পেতেন, কোথায় তাঁদের ভুল ও দুর্বলতা। কোথায় তাঁদের সবলতা। কিন্তু টিআইবির জরিপ প্রতিবেদন নিয়ে মন্ত্রী ও তাঁদের পারিষদেরা এমন হইচই শুরু করলেন যে সবকিছু সেই আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে গেল। আওয়ামী লীগের নেতারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, কেউ তাঁদের ভুল ও দুর্বলতা ধরিয়ে দিলে তাঁকে ষড়যন্ত্রকারী বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁরা সমালোচক চান না, চান দালাল ও তোষামোদকারী।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সম্পর্কে জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এমন হলো। তিনি বললেন, ‘কোথাও চেইন অব কমান্ড নেই, কেউ কাউকে মানে না। যোগ্যরা কল্কে পান না, অযোগ্যরা গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে আছেন। ঢাকার থানাগুলোতে একটি বিশেষ জেলার পুলিশ কর্মকর্তাদের বসানো হয়েছে। তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু তাঁদের আগের রেকর্ড তো দেখতে হবে।’ তিনি আরও বললেন, ‘একটি থানার ওসি যখন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে পদায়িত হন, তখন তিনি পুলিশ সুপার বা স্বরাষ্ট্রসচিবের নির্দেশ মানবেন কেন? দলীয় লোক দিয়ে প্রশাসন চালানো যায়, কিন্তু অযোগ্যদের দিয়ে নয়।’ এমনটি যে কেবল পুলিশ প্রশাসনে ঘটেছে, তা নয়। জনপ্রশাসনের সর্বত্র নব্য আওয়ামী লীগারদের দৌরাত্ম্য।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি বা চারদলীয় জোটের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও দুঃশাসনই ছিল আওয়ামী লীগের বড় শক্তি। দুই বছর পার হয়ে গেছে। এখন ভোটারদের টানতে হলে কাজ দেখাতে হবে। বিএনপি বা চারদলীয় জোটের গিবত গাইলে লাভ হবে না। আওয়ামী লীগের বিরাট মন্ত্রিসভা, জাতীয় সংসদের প্রায় সবটা তাদের দখলে, প্রশাসন তাদের মনমতো সাজানো, পুলিশ বিভাগ সাজানো। তার পরও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কোনো প্রকল্প সময়মতো শেষ হচ্ছে না। তাহলে বিরোধীদের দোষ দিয়ে কী লাভ? জনগণ এখন দেখতে চাইবে, গত দুই বছরে সরকার তাদের জন্য কী কী করেছে। যে মানুষের পেটে ভাত নেই, তাকে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে লাভ নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর সরকার উত্তরাঞ্চল থেকে মঙ্গা দূর করেছেন, কিন্তু বাজারে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে, তা কেনার সামর্থ্য মানুষের আছে কি না। থাকলে ওএমএসের চালের জন্য মানুষের লাইন এত দীর্ঘ হতো না। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের মিল না থাকলে মানুষ ক্ষুব্ধ হবে, আন্দোলন করবে। সেই আন্দোলনের পেছনে ষড়যন্ত্র খুঁজে লাভ নেই। নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে হবে। ভোটারদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আরেকটি কারণ, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়াবাড়ি। ছাত্রলীগ, যুবলীগের মাস্তানি, চাঁদাবাজি। তারা আইন মানে না, প্রশাসন মানে না। যেখানে যা পায়, সবকিছু দখল করতে চায়।
আমরা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছি, উত্তরাঞ্চলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির পেছনে দুটি ঘটনাও কাজ করেছে। পাবনায় সরকারি কর্মচারী পরীক্ষা ভণ্ডুল এবং নাটোরের বড়াইগ্রামের উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা। প্রথম ঘটনা যাঁরা ঘটিয়েছেন, তাঁরা সবাই সরকারি দলের কর্মী ও ক্যাডার। কিন্তু বিচারে কারও শাস্তি হয়নি। বরং প্রজাতন্ত্রের হয়ে যাঁরা পরীক্ষার আয়োজন করতে গিয়েছিলেন, সেই কর্মকর্তাদের অপমানজনকভাবে বদলি করা হয়েছে, শাস্তি পেতে ও অপদস্থ হতে হয়েছে। অন্যদিকে বড়াইগ্রামে উপজেলা চেয়ারম্যানকে দিনদুপুরে হত্যা করা হলেও মূল ঘাতক এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকারি দলের সাংসদ থেকে শুরু করে নেতা-পাতিনেতা, ছাত্রলীগ, যুবলীগের ভয়ে তটস্থ থাকেন থানার ওসি থেকে শুরু করে ইউএনও, পুলিশ সুপার থেকে জেলা প্রশাসক, সবাই। পৌর নির্বাচনে তারই মোক্ষম জবাব দিয়েছেন প্রশাসন ও জনগণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতই বলুন না কেন, তাঁর সরকার শাসক নয়, সেবক; দলের নেতা-কর্মীরা সেই কথা কখনোই আমলে নেন না।
অতএব, ১২ ও ১৩ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে অর্ধেক পৌরসভায় হেরেছে, তার কারণ কেবল অভ্যন্তরীণ কোন্দল নয়; অসহিষ্ণুতা, আইন না মানা এবং সর্বক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি। বিএনপি হরতাল ডাকলে আওয়ামী লীগ রাস্তা দখল করে মিছিল করে। সরকার কোনো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলে আওয়ামী লীগের মাস্তানেরা টেন্ডার দখল করে, সরকার কোনো অফিসের শূন্যপদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির জন্য পরীক্ষার আয়োজন করলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের পান্ডারা পরীক্ষাকেন্দ্রে ভাঙচুর করে। এর জবাবই ভোটাররা দিয়েছেন।
কেবল স্থানীয় ঘটনা নয়, কেন্দ্রীয় রাজনীতিও এবারের পৌরসভা নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। আওয়ামী লীগের ভাষায় জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত বিএনপিই শুধু পৌর নির্বাচনে ভালো করেনি, মৌলবাদী জামায়াতও পাঁচটি পৌরসভায় জিতেছে। এর কী ব্যাখ্যা দেবেন আওয়ামী লীগের নেতারা? বিএনপি উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগের ৭২টি পৌরসভার মধ্যে ৩৫টিতে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে এখন অনেকটাই আস্থাশীল। নেতা-কর্মীরাও উজ্জীবিত।
দক্ষিণের দুই বিভাগে ৪৯টি পৌরসভার মধ্যে ১৭টিতে বিএনপির বিজয়ও ছিল চমকপ্রদ। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে তাদের ভোট বেড়েছে উল্লেখ করার মতো। আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত বেশ কিছু এলাকায় বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হয়ে দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিরই প্রমাণ দিয়েছেন।
তবে এই নির্বাচনে সরকার একটি কৃতিত্ব নিশ্চয়ই দাবি করতে পারে, তা হলো কোনো জবরদস্তি না করা। দলীয় সরকারের অধীনেও যে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে, সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচন তা প্রমাণ করেছে। আগামী সিটি করপোরেশন ও উপনির্বাচনেও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে জাতীয় নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘আপদ’ মাথায় নিতে হবে না। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, তার অধীনে জাতীয় নির্বাচন অসম্ভব হবে না। যে বিএনপি পৌর নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির আশঙ্কা করে সব কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে, সেই বিএনপিই নির্বাচনের পর স্বীকার করেছে, নির্বাচন মোটামুটি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরোধী দলের এই স্বীকারোক্তিও ইতিবাচক বলে মনে করি।
আজ সোমবার ঢাকার ৬৩টি এবং কাল সিলেট ও চট্টগ্রামের যথাক্রমে ১৬ ও ৪৩টি পৌরসভায় ভোট হবে। এর ফলাফল কী হবে জানি না, তবে এই তিনটিতেও আগের ধারা বহাল থাকলে ক্ষমতাসীনদের খবর আছে, আর যদি এই তিনটিতে তারা ভালোও করে, ভোটের বাক্সে ভাটার যে টান পড়েছে, তা ফেরাতে পারবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.