স্মরণ-আবদুস সামাদ আজাদ by আজিজুস সামাদ আজাদ

বাবার জন্ম ১৯২২ সালে। পিতা মো. শরিয়ত উল্লাহ। জন্ম ১৫ জানুয়ারি, ভুরাখালী গ্রামে। এ গ্রামের অবস্থান এমন এক জায়গায়, বর্ষাকালে চারদিকে পানি জমে। সবচেয়ে কাছের জনবসতিটাও ৮-১০ মাইল দূর। বাবা স্কুলে যেতেন ৮-১০ মাইল হেঁটে। বর্ষাকালে নৌকায়।


এ জন্যই তিনি শুধু তাঁর এলাকায়ই নয়, যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ তৈরিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। তিনি বলতেন, আমি যে কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি, আর কাউকে যেন সে রকম কষ্ট করতে না হয়। নিজের মুখ থেকে শোনা তাঁর বাল্যকালের একটি গল্প। তখন তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন তিনি তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের গাড়ির সামনে শুয়ে পড়লেন। গাড়ি থেকে নেমে এলেন প্রশাসক। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? বাবা উত্তর দিলেন, রাস্তা চাই, হাওরের মধ্য দিয়ে। প্রশাসক জানালেন, অসম্ভব চিন্তা। হাওরের ঢেউ রাস্তা ভেঙে ফেলবে। ওই ছেলেটির তাৎক্ষণিক উত্তর, বর্ষায় তার অসুবিধা হয় না, নৌকা আছে। শীতে হেঁটে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এবড়ো-খেবড়ো হাওর পাড়ি দেওয়া কষ্টকর। শীতে রাস্তা থাকবে, বর্ষায় পানিতে ডুবে যাবে। সাবমার্জ রাস্তার ধারণাটি ওই বাচ্চা ছেলেটির মাথায় তখন আসন গেঁড়ে বসেছিল। ছোটবেলা থেকেই হাওরের মানুষের সুবিধা-অসুবিধা, তাঁর চিন্তা-চেতনায় আলোড়ন তুলেছিল। পরবর্তী জীবনে হাওরের মানুষের সমস্যার সমাধানই হয়ে উঠেছিল তাঁর একমাত্র ধ্যান-ধারণা ও জীবনের মূল লক্ষ্য। সে জন্যই ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু যখন তাঁকে কৃষি, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে বললেন, তখন দ্বিতীয় কোনো চিন্তার প্রয়োজন হয়নি। ১৯৫৮ সালের ২৮ জুন বিয়ের তিন মাস পরই ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খানের সামরিক আইন। ফের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, ফের সম্পত্তি ক্রোক। বাবা বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে বেড়াতেন। মা যেতেন দেখা করতে। কখনো কাজের বুয়া, কখনো ভিখারিনীর সাজে। এত ঝামেলার মধ্যে আমার জন্ম। ফার্মগেটের পেছনে একটা বাড়িতে। আমার জন্মের চার মাসের মাথায় বাবা ধরা পড়লেন। বাবারই এক পরিচিতজনের বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়েছিলেন। তার নাম কখনোই বলেননি, তবে তাকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। মা এরপর বাধ্য হলেন আমাকে আমার খালা আয়েশা বানুর কাছে রেখে আসতে। বাবা জেলে, আমি খালার কাছে পাবনায় আর মা নুরুন্নাহার চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ করতে।
বাবাকে জেল থেকে বের হওয়ার জন্য এবার অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৬২ সালের কোনো একসময় পর্যন্ত। আবার আমি, মা, বাবা একসঙ্গে থাকা শুরু করলাম। এবার ক্রিসেন্ট রোডে। কিন্তু সে সুখ বেশি দিন সয়নি। ছোট ভাই আতিক জন্মাবার তিন মাসের মাথায় '৬৪ সালের কোনো এক ভোররাতের কথা। হাল্কা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর দেখি ঘরে আলো জ্বলছে। খাটের এক পাশে মা দাঁড়ানো, আরেক পাশে বাবা। ঘর থেকে বের হওয়ার দরজা খোলা। সেখানে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। মায়ের চোখে পানি কিন্তু কোনো শব্দ নেই। আমার বয়স তখন চার বছর। চার পাশে প্রচুর পুলিশ। এনডিএফ অফিসের সামনে একটা পুলিশের ট্রাক। বাবা ট্রাকে করে গেলেন।
২৪ বছরের একটা মেয়ে, তিন-চার মাসের একটি ছেলে কোলে আর বহু প্রশ্নে জর্জরিত করা একটি ছেলে। স্বামী জেলে, কবে বের হবেন জানা নেই। জীবিকার জন্য শিক্ষকতা করেন। মতিঝিল গার্লস স্কুলে।
বাবার জীবনের প্রতিটি ইঞ্চি যেমন লেখা সম্ভব নয়, তেমন চেষ্টাও কেউ কখনো করেননি। আমরাও বহুবার বাবাকে তাঁর জীবনী লেখার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি, তিনি রাজি ছিলেন না। তিনি বলতেন, 'জীবনীতে মিথ্যা বলা বা জেনেশুনে সত্য গোপন করা উচিত নয়। কিন্তু আমি এমন কিছু সময়ের সাক্ষী যা বাইরে প্রকাশ পেলে ইতিহাস দংশিত হতে পারে বিষধর সাপের দ্বারা।' আরো বলেছেন, 'আমি প্রাচীন বটবৃক্ষ, সাক্ষী হিসেবেই থাকতে দাও, সাক্ষ্য দিতে বলো না।' আর কখনোই বলিনি।
আজিজুস সামাদ আজাদ

No comments

Powered by Blogger.