জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-শ্রেণীকক্ষ বর্জনের আন্দোলন সমর্থন করি না by শফি আহমেদ

গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে সংবাদ ও আলোকচিত্র প্রায় প্রতিদিনই প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন সংবাদপত্রে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি প্রায় ৩৭ বছর। বিদায় নেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। মনে হলো, কিছু না লিখলে আমার দায়মুক্তি হবে না।


বর্তমান অবস্থার মূলে রয়েছে একটি শোকাবহ হত্যার ঘটনা। আমি যে বিভাগে পড়াই, সেই ইংরেজি বিভাগেরই ছাত্র জুবায়েরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আমাদের বিভাগ থেকে জুবায়ের হত্যার ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভাগ থেকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিভাগীয় চেয়ারম্যান শিক্ষার্থীদের সর্বশেষ পরিস্থিতির বিষয়ে অবহিত করেছেন। বিভাগের সব শিক্ষার্থীকে নিয়ে একসঙ্গে বসে আলোচনা হয়েছে। শিক্ষকেরা মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীদের নিয়ে। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিভাগের সবাই কালো ব্যাজ ধারণ করেছেন। এভাবে শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে প্রথম দুই দিনের পর থেকে আমরা নিয়মিতভাবে ক্লাস নিয়েছি। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সহজেই বোঝাতে পেরেছিলেন যে ক্লাস বর্জন করে আন্দোলনের প্রতিবাদী মাত্রা প্রদর্শনের মাধ্যমে লাভের চেয়ে তাদের ক্ষতিই বেশি। তাই ইংরেজি বিভাগের ক্লাস, পরীক্ষা, সভা ও অন্যান্য নিয়মিত কার্যক্রমের ব্যাঘাত ঘটেনি।
কিন্তু আমারই কিছু প্রিয়ভাজন সহকর্মী দুই মাস ধরে যেভাবে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তা আমাকে ব্যথিত করেছে। এ ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় শিক্ষকদের মধ্যে বিরোধ একপর্যায়ে প্রায় সহিংস হয়ে ওঠে বলে শুনেছি। সমিতির সভায় তীব্র বাদানুবাদ উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থার সৃষ্টি করে। শিক্ষকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আলাদা একটা দল ‘শিক্ষকসমাজ’ সৃষ্টি করলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নির্বাচিত শিক্ষক সমিতি আছে। সেখানে সভাপতিসহ আরও কয়েকজন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি আছেন, যাঁরা কথিত উপাচার্যবিরোধী প্যানেল থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাহলে আমার শ্রদ্ধেয় ও প্রিয়ভাজন সহকর্মীদের কাছে প্রশ্ন, আপনারা গণতান্ত্রিক একটি সংগঠনকে শক্তিশালী ও কার্যকর না করে আলাদা নামে ‘শিক্ষকসমাজ’ নামে গোষ্ঠী গঠন করে কি শিক্ষকদের মধ্যে প্রায় আনুষ্ঠানিক বিভক্তি ঘটালেন না? বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষকসমাজ’ বলে একটি সংগঠন আছে, অথচ আমি তার অংশ নই, তা ভাবতে ভালো লাগে না। এখানে শিক্ষকদের একটা ‘জাতীয়তাবাদী ফোরাম’ আছে, যার সদস্যরা এমন রাজনৈতিক দলের অনুসারী, যে দলকে আমি সমর্থন করি না, কিন্তু আলাদা চিন্তার জন্য তাদের সাংগঠনিক অবস্থানের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু ‘শিক্ষকসমাজ’ সংস্থার শিক্ষক সমিতি নিরপেক্ষ অবস্থানকে আমি বিভক্তিসূচক বলেই বিবেচনা করি।
বাংলাদেশে সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগরের অবস্থাই কি সবচেয়ে খারাপ? জুবায়ের হত্যার মতো ঘটনা কি আর কোথাও ঘটেনি? বছর দুয়েক আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী হত্যার অভিযোগ ও শাস্তি নিয়ে কতটা অগ্রগতি হয়েছে? কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যে তাণ্ডব ঘটেছে, তার কি সমাধান হয়েছে এসবের? এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষকসমাজ’ কি উপাচার্যের পদত্যাগের জন্য কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে? জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্য কি এতই নিকৃষ্ট যে তাঁর পদত্যাগ ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখা যাবে না?
‘শিক্ষকসমাজ’ মাস খানেক আগে একটি মুদ্রিত পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম থেকে ২০০২ ও ২০০২ থেকে ২০০৯ এবং তারপর এই উপাচার্যের দায়িত্ব পালনকালীন তথ্য দিয়েছেন গ্রাফের মাধ্যমে। দেখা যাচ্ছে, গত তিন বছরে ১৯৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা আগের দুই পর্বের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু ‘শিক্ষকসমাজ’ প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে এ কথাও কি উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল না যে এই তিন বছরে কতগুলো নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে? বিভাগীয় সভাপতির অসম্মতিতে কি বাড়তি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে? বিভাগীয় সভাপতিরা তো আবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের তো আর উপাচার্য সরাসরি নিয়োগ দেন না।
বহু বছর ধরে আমাদের রাজনীতিতে যেভাবে বেনোজল ঢুকে পড়েছে, তাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দূষণমুক্ত দ্বীপ হিসেবে বিবেচনা করা চলে না। বহু বছর ধরে এটা স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গেছে, উপাচার্য নিয়োগ দেবে সরকার এবং তেমনভাবে নিযুক্ত একজন উপাচার্যের কাছ থেকে কি আমরা যুধিষ্ঠিরের আচরণ প্রত্যাশা করব? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পক্ষে আমি সাফাই গাইছি না। বলতে চাইছি, তাঁর পদত্যাগ দাবি করার মধ্যে সমাজবাস্তবতার কোনো যোগ নেই এবং এভাবে একজন ছাত্রের মৃত্যুকে পুঁজি করে তাঁর পদত্যাগের দাবি গণতান্ত্রিক আচরণ বলে বিবেচিত হতে পারে না। অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারের বহু পুরোনো দৃষ্টান্ত আছে। আমি চাই, গত ২০-২২ বছরের সব দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার ও নিয়োগে অনিয়ম দেখার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে আবেদন জানানো হোক।
এর আগেও উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে এমন কর্মবিরতির ডাক উপেক্ষা করে আমি ক্লাস নিয়েছি, অন্যান্য সহকর্মীকে ক্লাস নিতে উদ্বুদ্ধ করেছি। বিনয়ের সঙ্গে বর্তমান কর্মবিরতি সম্পর্কে বলতে চাই যে দেখতে হবে তা যেন অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন না করে। আমার কর্মস্থলে যাওয়ার বাস তাঁরা গেট দিয়ে ঢুকতে দেবেন না, কাফনের কাপড় পরে শুয়ে পড়বেন প্রশাসনিক ভবনের সামনে, অন্যের অফিসে তাঁরা তালা লাগিয়ে দেবেন—এটা মানতে পারি না। আমি সহকর্মীদের মতান্তরকে গণতান্ত্রিক বোধ দিয়ে সহ্য করব, কিন্তু সমর্থন করব না।
উপাচার্য যদি পদত্যাগ করেন, তাঁর তাৎক্ষণিক ফল কী হবে? বর্তমান সহ-উপাচার্য কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণ? তাঁকে কি আমরা নিঃসন্দেহে যোগ্যতর ও সুদক্ষ বিবেচনা করছি? সরকারের মুখাপেক্ষী তো আমাদের হতেই হবে। সরকার কি তখন শিক্ষকসমাজের নেতা বা শিক্ষক সমিতির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে উপাচার্য নিয়োগ দেবে?
অবশ্যই বলব, কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপাচার্যের নেতৃত্বের ঘাটতি থেকে গেছে। শিক্ষকদের সঙ্গে উপাচার্যের এমনই দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে যে তিনি তাঁদের সঙ্গে সংলাপেও বসতে পারছেন না। এ-ও উপাচার্যের ব্যর্থতা। আবার উপাচার্য জুবায়ের হত্যার জন্য যে দ্রুত ও কঠিন পথে তৎপরতা দেখিয়েছেন, যার ফলে আবাসিক হল থেকেই ছাত্র আটক সম্ভব হয়েছে, সে জন্যও তাঁকে ধন্যবাদ দিতে হবে। যে ক্ষেত্রে সরকারের সমর্থনপুষ্ট ছাত্র সংগঠন জড়িত থাকে, সে ক্ষেত্রে এমন তৎপরতার নজির দুর্লভ। শিক্ষক হলেও আসলে ভোটার নিয়োগের রীতি বেশ পুরোনো ও দেশব্যাপী প্রচলিত। আমি এর তীব্র নিন্দা করি। কিন্তু আমরা তা ঠেকাতে পারি না, সে জন্য লজ্জিত ও গ্লানি বোধ করি। আবার শিক্ষকসমাজের নেতারা যখন তাবৎ শিক্ষককুলকে হয় উপাচার্যের চাটুকার, না হয় স্থিতাবস্থায় আরামপ্রিয়, না হয় স্বার্থের খাতিরে ভীষণ হিসেবি, না হয় বর্তমান কর্মস্থলের চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি অধিক অনুগত—এমন নিন্দার নানা সারিতে দাঁড় করিয়ে বিভক্তির জায়গাটাকে প্রবলভাবে চিহ্নিত করতে চান, তখন মনে হয়, এই যে বিভিন্ন কিসিমের সুবিধাবাদী শিক্ষক, তাঁরা তো সবাই গত তিন বছর নিয়োগপ্রাপ্ত নন। শিক্ষকসমাজের অনেকেই যে এঁদেরই ছাত্রছাত্রী। এ বিষয়টি গৌরবের, নাকি গ্লানির তা বুঝতে পারছি না।
জাতীয় রাজনীতিতে অসহনীয়তা ও সংঘর্ষের আবহ দেশবাসীকে বর্তমানে অসহায় ও বিপন্ন করে তুলেছে। তাই শিক্ষকদের আন্দোলনে একটা শিক্ষণীয় গণতান্ত্রিক ধারা সৃষ্টি করা উচিত। শিক্ষক আন্দোলনের মাধ্যমে যেন পুনরায় সেশনজট সৃষ্টি না হয়। আন্দোলন এমনভাবে সংহত করে তোলা হোক, যার দাবি হবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনুযায়ী অনতিবিলম্বে সিনেটে নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল তৈরি করতে হবে। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি স্বেচ্ছাচার ও স্বজনপোষণ তদন্ত করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে যথাযথ অভিযোগ পেশ করতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই কর্মবিরতি এবং কাজ না করে বেতন-ভাতার বিলে স্বাক্ষর নয়।
 শফি আহমেদ: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.