মানুষের কল্যাণে জীবন দিতে প্রস্তুতঃ সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী by শামীম খান

সমুদ্রবিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতে (ইটলস) মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা মামলার রায়ে বাংলাদেশ জয় লাভ করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। শনিবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেশের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকসহ বিশিষ্ট নাগরিকরা প্রধানমন্ত্রীকে এ সংবর্ধনা দেন।

বিকেল পাঁচটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত হওয়ার পর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। মঞ্চের সামনে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে করতালির মাধ্যমে স্বাগত জানায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নাগরিক সমাজের সহযোগিতা চেয়ে বলেন, ‘নাগরিক সমাজের সঙ্গে আমাদের আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। তারা আমাদের আগামী দিনের চলার পথে পরামর্শ দেবেন সুষ্টুভাবে দেশ পরিচালনার। আপনাদের কাছে এই সহযোগিতা চাই।’

শনিবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এ নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজন এবং দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।’

তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে সরকার গঠনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন বলেই আমরা এই জয় আনতে পেরেছি। এই জন্য আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই, শুভেচ্ছা জানাই।’

বিকেল ৫টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলে সমুদ্র বিজয় উদ্যাপন জাতীয় নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রীকে মঞ্চে নিয়ে যান।

এ সময় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানাতে আসেন কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতি কর্মী-সাংবাদিক-শিক্ষক-রাজনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার হাজার হাজার মানুষ। এসময় করতালি দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান তারা।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই মানপত্র পাঠ করেন কবি সৈয়দ শামসুল হক। এরপর দেশাত্ববোধক সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়।

নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, সেই বন্ধুত্বতা মেনেই আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে আমরা সমুদ্রে আমাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। এই কাজে সংশ্লিষ্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, নৌ-বাহিনী, আন্তর্জাতিক আইনজীবীসহ সকলকে ধন্যবাদ।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য আমাদের দেশ হবে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দেশ। যেখানে থাকবে সকল ধর্মের সকল মানুষের সমান অধিকার। বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার সবচাইতে উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশ।

আমাদের অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। এই গণতন্ত্রের চর্চাকেন্দ্র এই সংসদ। এই সংসদে এরকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য আয়োজকদের আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আজ সমুদ্রে আমাদের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। এই সমুদ্রের খনিজ, জলজ এবং মৎস সম্পদে আমাদের অধিকার জন্মেছে। আগে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারপর তা ভোগ করতে হবে। যেটা অতীতে কখনো করা হয়নি।

ভারতে সঙ্গে সমুদ্র নিয়ে আমাদের রায় ২০১৪ সালে। দেশের জনগণ যদি আমাদের উপর আস্থা রাখে, বিশ্বাস রাখে এবং আমাদের ভোট দেয় তবে আমাদের সকল প্রচেষ্টা থাকবে সেই রায় দেশের পক্ষে আনার জন্য।’

এ সময় প্রধানমন্ত্রী আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘শুধুমাত্র জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু যে ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন আমি পিতার কন্যা হিসেবে পিতার মতই দেশের জনগণের স্বার্থে, জনগণের কল্যাণে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। এমন কি জীবনও উৎসর্গ করতে পারি। সব কিছু ছেড়ে দিয়ে দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি সব কিছুই করতে পারি। এর বেশি চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই আমার। আমার মৃত্যু ভয় নেই, কোনো কিছু হারানোর ভয় নেই। আমি শুধু মানুষের পাশে থাকতে চাই। এই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমুদ্র সীমা রক্ষার কিছু প্রস্তুতি আমরা ১৯৯৬ সালেই নিয়েছিলাম। এর জন্য ফ্রিগেট কিনেছি, মিগ কিনেছি, বিমান ঘাঁটি বানিয়েছি। বাংলাদেশ সমুদ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সমুদ্র সীমা আইন করেছিলেন। আমরা সেবার ব্রত নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু আমাদের পথ দেখিয়ে গেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র সাড়ে ৩ বছরে প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন। সেই পথ ধরেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘জাতির দুর্ভাগ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার মাধ্যমে দেশের অগ্রগতি পিছিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর দেশ যেভাবে গড়ে উঠার কথা ছিলো সে ভাবে গড়ে উঠেনি। মিলিটারি ডিকটেটররা ক্ষমতা দখল করে। এটা সত্য যে গণতান্ত্রিক সরকারই একমাত্র দেশের কল্যাণ করতে পারে। আজ বংলাদেশ সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদের দুর্নীতি আর বাংলাভাইয়ের দেশ না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই দেশ এগিয়ে যাবে। আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন ২০-২৫ বছর আগেই বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে দৃষ্টান্ত হতে পারতো। আর জনগণের ভাগ্য নিয়ে যাতে কেউ ছিনিমিনি খেলতে না পারে, গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে না পারে। সেই বাংলাদেশ গড়ে তুলে দুষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই। এ জন্য সবার সহযোগিতা চাই। নাগরিক সমাজের সঙ্গে আমাদের আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। তারা আমাদের আগামী দিনের চলার পথে পরামর্শ দেবেন সুষ্টুভাবে দেশ পরিচালনার। অতীতে কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা সকল আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের পাশে থেকে পরামর্শ দিয়েছেন সহযোগিতা করেছেন।

আগামীতেও আমরা সেই পরামর্শ, সহযোগিতা চাই।’

শেখ হাসিনা সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘এই সংবর্ধনা দেশের মানুষের লাখো জনতার, লাখো শহীদের। তাদেরকে সব উৎসর্গ করতে চাই। আমি দোয়া চাই, আমরা যেন জাতির পিতার স্বপ্ন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত দেশ গড়ে তুলতে পারি, ২০২১ সালের সুবর্ণ জয়ন্তী যেনো সমৃদ্ধ জাতি বিশ্বে বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। বাংলাদেশকে আমরা সবুজে-সুনীলে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবো।’

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আআমস আরেফীন সিদ্দিকী, জাতীয় অধ্যাপক এমআর খান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

No comments

Powered by Blogger.