যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তর-হিলারির সফরে 'চমৎকার' সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হবে by মেহেদী হাসান

ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে বিভিন্ন মহল থেকে টানাপড়েনের কথা বলা হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে 'চমৎকার' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। আর এই চমৎকার সম্পর্কের সুবাদেই হিলারি ক্লিনটনের মতো ওবামা প্রশাসনের এমন গুরুত্বপূর্ণ নেতা আগামী ৫ মে ঢাকা সফরে আসছেন বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করছে।


যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে সর্বশেষ গত ৬ মার্চ হালনাগাদ করা বাংলাদেশ সম্পর্কিত অধ্যায়ের 'যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক' শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কারণে প্রথম দিকে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে সমস্যা ছিল। তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর দ্রুত ঢাকা-ওয়াশিংটন মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক জোরালো হয়।
এতে আরো বলা হয়, 'যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক চমৎকার। ২০০০ সালের মার্চে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্লিনটনের, ২০০৩ সালের জুনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েলের, ২০০৪ সালের জুনে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ডের সফরের মধ্য দিয়ে এ সম্পর্ক জোরদার হয়েছে।'
বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামার বৈশ্বিক চার উদ্যোগের সবগুলো থেকেই সুবিধা পেয়েছে। এ দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, দুর্যোগ মোকাবিলা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, গণতন্ত্র ও সুশাসন, শান্তি, নিরাপত্তা, মানব পাচার রোধসহ উন্নয়নকাজে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হিলারির ঢাকা সফরের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ককে 'জোরালো' হিসেবে আখ্যায়িত করে এই সফরের মধ্য দিয়ে তা আরো জোরালো হওয়ার আশা প্রকাশ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ সফরে নিরাপত্তা সহযোগিতা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব ইস্যুতে আলোচনা হবে বলে বাংলাদেশ আশা করছে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বরাবরই ভালো ছিল। মাঝে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. ইউনূসকে অপসারণ ইস্যুতে কিছুটা সমস্যা দেখা দিলেও বাংলাদেশ সরকার স্পষ্টতই বলেছে, এটি এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সরকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেও সবাইকে বিষয়টি জানার সুযোগ করে দিয়েছে।
ওই কূটনীতিক আরো বলেন, এর আগে কয়েকবার হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরে আসার কথা থাকলেও শেষপর্যন্ত তা হয়নি। এই বিষয়টিকেই একটি মহল সরকারের সমালোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বলেছে, এ দেশের পররাষ্ট্রনীতি 'নতজানু'। আরো বলেছে, এ দেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদে হিলারি সফর হোক তা ওই মহল চায়নি।
ওই কূটনীতিক বলেন, হিলারির মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতার বাংলাদেশ সফর বর্তমান সরকারের জন্য প্রয়োজন ছিল। ভালো সম্পর্ক না থাকলে এ ধরনের সফর হয় না। এটি দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। হিলারির সফর দুই দেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম ওয়ালিউর রহমান বলেন, হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহল বিশেষ ইউনূস ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপড়েনের কথা প্রচার করেছিল। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক বেশ ভালো। এই সফরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ বাড়াতে ইতিবাচক আলোচনা হবে বলে আশা করছি। এ ছাড়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তির (টিকফা) ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তিনি আশা করেন, নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান ড. দেলোয়ার হোসেন গতকাল বলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদ শুরু হয়েছিল ঢাকা-ওয়াশিংটন সুসম্পর্কের ইঙ্গিত নিয়ে। একে আরেকটি মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এ ধরনের সফর দরকার ছিল।
ড. দেলোয়ার মনে করেন, গত ১৯ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র প্রথম নিরাপত্তা সংলাপ দুই দেশের সম্পর্ককে আরো জোরালো করার সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের গুরুত্ব সব সময়ই ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক, নিরাপত্তাগত কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরো বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি প্রতিবেশী মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও সমুদ্রসীমার রায়ের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, 'মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিয়ে মামলার রায়ে বাংলাদেশ যে বিশাল সাগর এলাকা পেয়েছে, তা কতটা আমরা কাজে লাগাতে পারব সেটি ভিন্ন বিষয়। তবে বাংলাদেশের অধিকারের আইনগত বৈধতা এ দেশের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।'
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ হিলারি ক্লিনটনের আসন্ন সফর সম্পর্কে বলেন, সরকারের মেয়াদের প্রথম দিকে আসা আর সাড়ে তিন বছর পর আসা ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে। গত সাড়ে তিন বছরে তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোতে এলেও বাংলাদেশে আসেননি। তাই এই সফরে অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়ন প্রচেষ্টার চেয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশি গুরুত্ব পেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা বারবার বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও ঐক্যমতের কথা। এমন বক্তব্য আসতে পারে হিলারির কাছ থেকেও।
ইমতিয়াজ আহমেদ আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে টিকফা নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। সেটি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুও উঠতে পারে। এ ছাড়া সন্ত্রাসবাদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কৌশলগত মিত্র হিসেবে দুই দেশের কাজ করার ঘোষণাও আসতে পারে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর খোঁজ যদি আগামী ৫ মে হিলারির সফরের আগে না মেলে- অবশ্যই দলটি এ ইস্যুতে আলোচনা করবে।
ড. ইমতিয়াজ মন্তব্য করেন, গত সাড়ে তিন বছরে দুই দেশের সম্পর্কে যদি ভাটা পড়ে থাকে, তবে তা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ করে দেবে হিলারির সফর।

No comments

Powered by Blogger.