সাহসী সময়ের পুরোধা ব্যক্তিত্ব by একরামুল হক শামীম

সময়ের সঙ্গে ইতিহাস এগিয়ে চলে। নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাগুলো জমা পড়ে ইতিহাসের পাতায়। যুগান্তকারী ইতিহাসের নেপথ্যে থাকে ত্যাগী কিছু মানুষ। বাঙালি জাতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কিছু নেপথ্য নায়কের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা আজীবন পেছনে থেকে ইতিহাসের জন্য সবচেয়ে বড় কাজটিই করে গেছেন।


এমনই একজন মানুষ তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক। গতকাল ২৩ জুলাই ছিল ইতিহাসের এ নেপথ্য নায়কের জন্মবার্ষিকী।
১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই তাজউদ্দীন আহমদ গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার অন্তর্গত দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি নানা ধরনের প্রগতিশীল আন্দোলন এবং সমাজসেবার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ফলে এমএ পরীক্ষা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এমএলএ নির্বাচিত হয়ে তিনি আইন বিভাগের ছাত্র হিসেবে নিয়মিত ক্লাস করেছেন। পরে জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে আইনশাস্ত্রেও তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু তখনই তিনি সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত হননি। ১৯৬৬ সালে লাহোরে যে ছয় দফা দাবি পেশ করা হয়, তার অন্যতম রূপকার ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বিভিন্ন আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। সে রাতেই বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবল্পুব্দর অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের ওপর।
বাংলাদেশ সরকার গঠনের মূল দায়িত্ব পালন করেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে এ সরকার স্থানীয় জনগণ এবং শত শত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও প্রচারমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। এর মাধ্যমেই শুরু হয় বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাংলাদেশের ইতিহাসের ঐতিহাসিক এ সন্ধিক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ছিল চিরস্মরণীয়। জাতির চরম প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সামরিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বিষয়াদিসহ সব দিক সংগঠিত করে তোলেন।
এক সময় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। দেশে ফিরেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন। তখন দেশের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল পুনর্গঠন, পুনর্বাসন। সেই কাজটিই তাজউদ্দীন আহমদ সঠিকভাবে শুরু করতে পেরেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমান দেশে প্রত্যাবর্তন করলে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে তুলে দেন। তিনি নিজে মন্ত্রিপরিষদে থাকতে চাননি। তবে সে সময় অর্থমন্ত্রী হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতা দখলকারী ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহন হন বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমান। একই দিন সকালে তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দি করা হয় এবং পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্দি অবস্থাতেই ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারের সব নিয়ম ভঙ্গ করে বর্বরতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় তাজউদ্দীন আহমদ এবং জাতীয় অপর তিন নেতাকে। যিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরোধা পুরুষ, যিনি আজীবন জনগণের কল্যাণ নিয়ে ভেবেছেন, যে মানুষটি বাঙালি জাতির সুখী ও স্বাধীন জীবন গড়ার সংগ্রামে পরমভাবে নিবেদিত ছিলেন, সেই প্রচারবিমুখ, ত্যাগী ও কৃতী দেশপ্রেমিক মানুষটিকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক দল।
samim707@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.