তথ্যপ্রযুক্তি-ডিজিটাল কেনিয়া এবং বাংলাদেশ by মোস্তফা আমিন

সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের আওতায় অনেক প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছে। সেগুলোর কিছু কিছু বাস্তবায়নও হচ্ছে; কিন্তু যেখানে ইন্টারনেট স্পিডের কচ্ছপগতি, সেখানে শুরুতেই সেগুলোর মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যাযদি স্বাধীনতা না থাকে তাহলে কাজে গতি আসবে না। তেমনি চিন্তাতেও কোনো ক্রিয়েটিভিটি আসবে না।


স্বাধীনতা মানুষকে সব দিক থেকেই বড় করে। এ যুগে এসে অর্থনৈতিক বা চিন্তার মুক্তির সঙ্গে তথ্য পাওয়ার এবং দেওয়ার মুক্তিও যোগ হয়েছে। এ স্বাধীনতা বা মুক্তি ছাড়া এই ই-যুগে অন্য সমাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা অসম্ভব। তাছাড়া মানুষের মেধা বা চিন্তাকে আটকে রাখা কত বড় বোকামি তা কাউকে আলাদা করে বোঝাতে হবে না।
টাইমস পত্রিকা মাঝে মাঝে পড়া হয়। কিছুদিন আগে টাইমসের একটি সংখ্যায় কেনিয়া আর আফ্রিকার ওপর লেখা পড়ে মনটা একটু বিমর্ষ হয়ে গেল। কিছু তথ্য আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করি। ২০০৭ সালে কেনিয়ার ব্যান্ডউইথ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল। মাত্র একটি ফাইবার অপটিক, যার কিছু অংশ কেবল কয়েকটি দেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল! গত দুই বছরের মধ্যে কেনিয়া ছয়টি ফাইবার অপটিক দিয়ে কানেক্টিভিটি নিশ্চিত করেছে, যা তাদের যুক্ত করেছে আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার সঙ্গে। ২০১৩-এর মধ্যে এই ফাইবার অপটিকের সংখ্যা হবে ১২! গত চার বছরে আফ্রিকার ইন্টারনেট ক্যাপাসিটি প্রতি সেকেন্ডে ৩৪০ গিগাবাইট থেকে লাফ দিয়ে ৩৪ হাজার গিগাবাইটে পেঁৗছেছে, যা সত্যিই বিস্ময়কর! সেই সঙ্গে আফ্রিকার সরকারগুলো আইএসপি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতি মাসে প্রতি সেকেন্ড খরচ ৪ হাজার ডলার থেকে ২০০ ডলারে নামিয়ে এনেছে; যা পরে এ বছরই হবে ১০০ ডলার। এ বছরের শেষ দিকে নাইরোবির বাইরে স্থাপিত ৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত 'কড়হুধ ঞবপযহড়ষড়মু ঈরঃু' কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। যেখানে কনটেন্ট আর অ্যাপ্লিকেশন উদ্ভাবনের মেলা বসবে। গোটা আফ্রিকার অর্ধেক আর কেনিয়ার ৯২ ভাগ মানুষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অনলাইনে যায়। কেনিয়া সরকারের আইটি সেক্টরের জন্য ভালোবাসা আছে (যা আমাদের বর্তমান সরকারেরও আছে), যা তাদের এনে দিয়েছে একটি অন্য পরিচয়_ ঝরষরপড়হ ঝধাধহহধ! (আফ্রিকার ভূমি বিন্যাসই হলো 'ঝধাধহহধ'। ঝধাধহহধ হলো বিশাল সমতল ভূমি যা পাহাড় আর বনজঙ্গলে ঢাকা থাকে। এসবের ফলে আফ্রিকার ইন্টারনেট ট্রাফিক পৃথিবীর সবচেয়ে বর্ধনশীল। আফ্রিকায় শুধু ২০১০ সালে গুগলের অনলাইন বিজ্ঞাপনে ৫.২ বিলিয়ন ক্লিক পড়েছে যেখানে পশ্চিম ইউরোপে পড়েছে ৩.৭ বিলিয়ন!
আরও কিছু তথ্য যোগ করতে চাই। ২০০৯-এ বিশ্বব্যাংক তাদের এক সমীক্ষায় জানায়, উচ্চগতির ইন্টারনেটের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি সরাসরি যোগাযোগ আছে। সম্পর্ক অনেকটা এ রকম_ ইন্টারনেটের উচ্চগতি ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় ১.৩ শতাংশ। লন্ডন বিজনেস স্কুল, বিশ্বব্যাংক কিংবা ডিলোটির (যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অডিট, ফিন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজরি, কনসালট্যান্ট এজেন্সি) গবেষণায় এসেছে, আফ্রিকাতে প্রতি ১০০ জনের জন্য আরও ১০টি মোবাইল ফোন জিডিপি ০.৬ থেকে ১.২ শতাংশ বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
কেনিয়ার তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব বিটাঙ্গে এনডেমো (ইরঃধহমব ঘফবসড়) যখন বলেন, 'আমরা অবকাঠামো নির্মাণ করছি, এখন কনটেন্ট ও অ্যাপ্লিকেশনের সময়'; আমরা তখনও অবাক হই না, অবাক হই যখন দেশের মানুষের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আমরা আপনাদের চমকে দিতে যাচ্ছি!' আমাদের এমনই একজন স্বাপি্নক আর সাহসী মানুষ দরকার ছিল যিনি তথাকথিত আমলাতান্ত্রিক জটিলতার 'নাগপাশ' ছিঁড়ে আমাদের এমন সাহসী আর চমকে দেওয়ার মতো কথা শোনাবেন। কেনিয়াতে এরপর যা ঘটেছে, যেমন বিভিন্ন রকম সফটওয়্যার, মোবাইল ফোনভিত্তিক সেবা, কৃষিভিত্তিক সফটওয়্যার ইত্যাদি, তা আমাদের এখানে ঘটা আরও স্বাভাবিক ছিল। আমাদের তরুণ প্রজন্ম বহুকাল থেকে প্রমাণ করে চলেছে তারা কতখানি প্রতিভাবান। শত প্রতিকূলতা থাকার পরও কত কিছুই না তারা করে যাচ্ছে!
সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের আওতায় অনেক প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছে, সেগুলোর কিছু কিছু বাস্তবায়নও হচ্ছে; কিন্তু যেখানে ইন্টারনেট স্পিডের কচ্ছপ গতি, সেখানে শুরুতেই সেগুলোর মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। সরকারের কাছে দাবি, পরিবেশটা নিশ্চিত করুন, অবকাঠামো দিন, তারপর বাকি কাজ তরুণরাই করবে। ৪০ ভাগ তরুণ প্রজন্মের ভোট পেয়েছে এই সরকার এবং ক্ষমতায় এসেছে_ সেই তরুণ প্রজন্মের মেধা বিকাশের জন্য যদি পরিবেশ আর অবকাঠামো নিশ্চিত করা যায়, তাহলে বলা যায় এ সরকারের কাছে তরুণ প্রজন্ম তথা জাতি কৃতজ্ঞ থাকবে। তেমন হলে আমরা হয়তো দেখব নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট গুডলাক জনাথনের মতো নিকট-ভবিষ্যতে আমাদের রাজনীতিকরাও সামাজিক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রকাশ করছেন এবং প্রতিযোগিতায় মেতেছেন!

মোস্তফা আমিন : ব্লগার
mjgalib@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.