নিভেও জ্বলে থাকা বাতিঘর! by ফজলুল বারী

বিচিন্তা সম্পাদক মিনার মাহমুদের মৃত্যুর পর এক সপ্তাহের বেশি পেরিয়েছে। তিনি আত্মহনন করেছেন, এ নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ফাঁসির মঞ্চে কর্ণেল তাহেরের আবৃত্তি করা কবিতা ‘জন্মেছি পৃথিবীটাকে কাঁপাবো বলে কাঁপিয়ে গেলাম’ এর মতো তার প্রতিবাদী মৃত্যুও কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে গোটা বাংলাদেশের হৃদয়!

শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া বা তাঁর কাজে অনুপ্রাণিত-উপকৃত কেউই প্রতিবাদী এই মৃত্যুতে শোক জানিয়ে কোনো বিবৃতি দেননি, কোনো তোপধ্বনি করা হয় নি, আনুষ্ঠানিক শেষকৃত্য হয় নি, বিউগলে করুণ সুর বাজে নি, হয়নি কোথাও প্রথাওয়ালাদের কোনো নাগরিক শোকসভা! কিন্তু তাতে কী, বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় নাড়া দেওয়া, কেন এমন তিনি করলেন, এর জন্যে দায়ী কে-কারা, মিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রশ্নের সৃষ্টি তো হয়েছে।
অনেকে তাকে নিয়ে লিখেছেন; এখনও লিখছেন। এসবের মাধ্যমে অনেকের দাবি, জয়নাল হাজারী থেকে শুরু করে অনেকে নাকি তাকে চাকরিও দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন! একজন আবার বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে লিখেছেন, এখন মিনার মাহমুদের দেখাদেখি দেশের দ্রোহী যুবকরা আবার আত্মহনন বেছে নেয় কিনা! যেন এই প্রথম কেউ একজন আত্মহত্যা করেছেন পৃথিবীতে! এর আগেও যে দুনিয়াতে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন।

দুনিয়াতে মানুষের নানাভাবে মৃত্যু হয়, কেউ মরে রোগে, কেউ দুর্ঘটনায়, কেউ খুন হয় বা যুদ্ধে প্রাণ দেয়, স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যু হয় কারও কারও, বা অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নেন, কিন্তু এসবের চাইতেও যে তার-তাদের কীর্তি বড়, মরণশীল মানুষ মরে গেলেও কীর্তি থাকলে যে তা মরে না, তা মনে রাখলে ভালো হয়। এরপরও যারা লিখেছেন, লিখছেন, যারা লেখাগুলো ছাপছেন,  রবীন আহসানের মতো তরুণ একজন প্রকাশক, প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাকে নিয়ে একটি আলোচনা বৈঠকের ব্যবস্থা করেছেন, সবার প্রতি ‘বিচিন্তা’ পরিবারের পক্ষে কৃতজ্ঞতা।

আমার প্রথম সম্পাদক, সাংবাদিকতায় প্রথম শিক্ষক মিনার মাহমুদের মৃত্যু নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রথম দুটি লেখায় কিছু ভুল লিখেছিলাম। আমাদের সঙ্গীদের নাম লিখতে গিয়ে কার নাম আগে কার নাম পিছে এটি নিয়ে সমস্যা দেখে ইত্তেফাকের লেখায় সব নামই বাদ দিয়েছি। অগ্রজ রেজা সেলিম, বিচিন্তা পরিবারের বন্ধু নুরুল ইসলাম ছোটন ভাই, আমেরিকাপ্রবাসী মানিক রহমান, চট্টগ্রামের এজাজ মাহমুদ, কামরুল হাসান বাদল, মিনার মাহমুদের অনুজ মেহেদি’র সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটের যে কথাটি লিখেছি তা ঠিক না। আঠারো বছরের প্রবাস জীবনের ইতি টেনে দেশে ফেরত আসার সময় টাকাকড়ি সঙ্গে আনতে না পারলেও স্ত্রীভাগ্যে অর্থ সংকট তার ছিলো না। তবে মনে সংকোচ ছিল, এই টাকাকড়িতো তার না। আমেরিকার গ্রিনকার্ডের মায়া কাটিয়ে বড় আশা নিয়ে জননী-জন্মভূমি দেশে ফিরে আত্মমর্যাদার জায়গাটিতে পদে পদে যে হোঁচট খাচ্ছিলেন, তাতে অনেকের মতো আপস করে মানিয়ে নিতে পারেন নি। তেলবাজ, দলবাজ, ধান্দাবাজ, অনেকের মতো কিম্ভূতকিমাকার হয়ে বেঁচে থাকাও তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।

‘আমার ছেলেরা দেশে যেভাবে মর্যাদার আসনে আছে, দেশে ফিরলেতো আমি পায়ের ওপর পা রেখে বসে খাবো’, আমেরিকায় গর্ব করে এমন একটা কথা অনেককে বললেও আদতে মিনার মাহমুদ যে কারও ওপর নির্ভরশীল হওয়ার-থাকার মানুষ ছিলেন না সেটিই সত্য। বিচিন্তার সৃষ্টিকালের একজনের কাছে প্রত্যাশামতো সাড়া না পাবার বেদনার কথাও তিনি ঘনিষ্ঠজনদের বলেছিলেন। বিচিন্তা আবার দাঁড় করাতে পারেননি। বন্ধু’র মালিকানার পত্রিকা সমকালে যোগ দিয়ে কেন সেখানে তিনি টিকতে পারেননি, দেশে যেখানে যেখানে লিখতেন, তারা তাকে যোগ্য সম্মানী দিয়েছেন কিনা, এসবতো তারাই ভালো জানেন। মিনার মাহমুদকে কেন অচ্ছুতের মতো ‘আজকের প্রত্যাশা’র মতো একটি পত্রিকায় কাজ নিতে হবে, সেখানে তাকে নিয়ে ধৃষ্ট কাজকর্মের বৃত্তান্ত যারা জানেন তারা মানবেন, আত্মসম্মান রক্ষার স্বার্থে আত্মহননের মাধ্যমে কালের কাছে বিচিন্তার ইজ্জত বাঁচিয়েছেন এর জনক মিনার মাহমুদ! এসব নিয়ে এখন আর অনর্থক কারও ভীতসন্ত্রস্থ, উতলা হবারও দরকার নেই। কারণ মিনার মাহমুদ স্বহস্তে সবাইকে দায়মুক্তি দিয়ে গেছেন। তার মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করে যাননি। জগতের সকল প্রাণী সুখি হোক!

এ লেখার ‘বাতিঘর’ বিশেষণটি প্রিয় ফরিদুর রেজা সাগর ভাই’র লেখা অবিচুয়ারি থেকে নেওয়া। আমাদের বিচিন্তার সঙ্গে যারা হেঁটে আসছিলেন তাদেরই একজন সাগর ভাই। বিচিন্তার জন্যে অনেক আইডিয়া পরামর্শের পাশাপাশি পেস্টিং’এর দিন খাবারদাবার পিঠাঘর  থেকে পঁচিশ-তিরিশজনের খাবার পাঠাতেন সাগরভাই। আহ, সপ্তাহের সেইদিনটাতে ফিস্টের মতো আমরা ভালো খেতাম! শান্তিনগর মোড়ের সেই ছোট পরিসর কক্ষের ইমপ্রেস ভিডিও আজ ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, চ্যানেল আই’সহ অনেক প্রতিষ্ঠানে বিস্তৃত-বিশাল হয়েছে।  সেই সাগর ভাই আমাদের সময়ের নায়ক মিনার মাহমুদকে শোকার্ত মনে স্মরণ করেছেন দেখে, কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে এসেছে। লেখাটি পড়ে আবেগাক্রান্ত হয়েছেন আমার অনেক বন্ধু। শৈশবের শহর ভোলার বন্ধু মুকুল ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন, আমি যাতে আর দেশে না ফিরি। রায়হান-রিগ্যান সহ আরও অনেকের বার্তার আকুতিও এক। অথচ এরা সবাই এতদিন দিন গুনেছেন, কবে আবার ফিরব দেশে। কিন্তু যা-ই ঘটুক, দেশেতো ফিরতেই হবে। শাকুর মজিদের তৈরি একটি ভিডিও এখন অনলাইনে আছে। নিউইয়র্কে ট্যাক্সি চালাতে চালাতে শাকুর মজিদের কাছে স্বীকার করেছেন, দেশ থেকে চলে যাওয়াটা তার ঠিক হয়নি। এখন ঝাঁকের কৈ ঝাঁকে চলে যাচ্ছে! নিউইয়র্কের জীবনে কেমন আছেন, জানতে চাইলে কোনো জবাব না দিয়ে স্বভাবসুলভ হেসেছেন। শাকুর মজিদও আর তাকে জিজ্ঞেস করেন নি। তার ট্যাক্সি দাপিয়ে চলার সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডে ভেসে আসে মিউজিকের করুণ সুর। যে সুর দেশহীন একজন দেশপ্রেমিকের হৃদয়মথিত কান্নার! তার এই ভিডিওটি দেখেও শোকার্ত অনেকে বলেছেন, তার দেশে ফিরে না আসাই ভালো ছিল। কাছে সামনাসামনি না দেখি, অন্তত ভাবতে তো পারতাম বেঁচে আছেন মিনার মাহমুদ। এসব তার মতো একজন সৎ মানুষের প্রতি দেশের মানুষের ভালোবাসা-অনুভবের ছবি।

মিনার মাহমুদের সদ্য বিধবা স্ত্রী, আমাদের লাজুক ভাবীর আপত্তির কারণে তার মরদেহের কোনো ছবি মিডিয়ায় যায় নি। তাৎক্ষনিক শোকের আগুনে মিডিয়ার অনেকের সঙ্গে তার ব্যবহারও যথাযথ হয়নি।কিন্তু মিডিয়ার লোকজন বিষয়টিকে একজন বিয়োগবিধুর মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবেই নিয়েছেন। কৌশলে যারা ছবি তুলেছেন, তারাও তা ছাপেন নি বা প্রচার করেন নি। নজিরবিহীন ঘটনাটি অভিভুত করার মতো। প্রভাষ আমিনের লেখায় বিচিন্তা পরিবারের ইলিয়াস চরিত্রটি এসেছে। প্রথম বিচিন্তার অফিস সহকারী। এমন আরেকটি চরিত্র বাইন্ডার আখতার। দলবল নিয়ে বিচিন্তার বাইন্ডিং-প্যাকেটজাতকরণ, পত্রিকার গাড়ি ধরানো এসব কাজ ঝড়ের গতিতে হতো আখতারের নেতৃ্ত্বে। ঢাকা হকার্স ইউনিয়নে গিয়ে আমি প্রতি সপ্তাহে বিচিন্তা বিক্রির টাকা আনতাম। একদিনে তারা টাকা দিতে পারতেন না। দু’দিনে দিতেন। আবার বিচিন্তা বিলির দিন নেতাদের মধ্যে হাসিখুশি গোপন টাকার ভাগাভাগি চলতো দেখতাম! বিচিন্তা নিষিদ্ধ হবার পর হকার্স ইউনিয়নে গিয়ে টাকা দূরে থাক, বসার চেয়ারও আর পাই নি।সারাদেশের অভিজ্ঞতা ছিল প্রায় এক। এভাবে মিডিয়ার মানুষের শ্রমেঘামের টাকাকড়ি খাবলে খায় সুযোগ সন্ধানীরা! আবার পেড্রোলো পানির পাম্পের স্থানীয় ডিলার বিজ্ঞাপন বিলের পাওনা চেক পাঠিয়ে বলেন, আপনাদের বিপদের সময়ে টাকাগুলো জরুরি কাজে লাগতে পারে। এমন নানা অভিজ্ঞতায় ভরপুর আমাদের বিচিন্তা-জীবন। সে জীবনের বাতিঘর মিনার মাহমুদকে আমরা জীবিত ধরে রাখতে পারি নি। সে মিনার মাহমুদ বেঁচে থাকবেন আমাদের চেতনায়, সৃষ্টিতে। বাংলাদেশের যে যেখানে মিডিয়ার মাধ্যমে স্বৈরাচার, অনাচার, তেলবাজি, দলবাজি, ধর্মীয় কুপমণ্ডুকতা, ভণ্ডামি আর মানুষ ঠকানোর বিরুদ্ধে লড়বেন, মরে যাবেন কিন্তু স্বপ্ন-স্বত্তা হারিয়ে কাপুরুষের মতো মতলবী বেঁচে থাকার যৌক্তিকতা জাহির করবেন না; সেখানে প্রতিবাদের প্ল্যাকার্ডে একটি নাম জ্বলজ্বল করবে। প্রেরণার মিছিলে। মিনার মাহমুদের নাম। একটি জীবন নিভে গেলেও যে বাতিঘর জ্বালিয়ে রাখে হাজার জীবন।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.