স্মরণ-স্যার, আপনাকে বিনম্র শ্রদ্ধা by তাহমীনা বেগম

যারা চলে যায়, তাদের ভুলে যায় পৃথিবীর মানুষের হিসাবি হূদয়। শত কোটি মানুষের ভিড়ে হাতেগোনা কিছু মানুষ পৃথিবীর মানুষের স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে থাকেন, তাঁদের কর্ম তাঁদের বাঁচিয়ে রাখে—তাঁরা চিরজীবী। এমন একজন মানুষ অধ্যাপক ডা. চৌধুরী বদরুদ্দিন মাহমুদ, বিশিষ্ট শিশুরোগ চিকিৎসক, আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষক।


১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে জন্ম নেন এই ক্ষণজন্মা মানুষটি।
১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।
১৯৭৮ সালে উচ্চতর ডিগ্রি এফসিপিএস সম্পন্ন করে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে শিশুদের চিকিৎসায়, শিশুদের সেবায় আমৃত্যু নিজেকে উৎসর্গ করেন।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৮১ সালে এবং সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন ওই মেডিকেল কলেজেই দীর্ঘ ১৮ বছর। ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং অধ্যক্ষ হয়ে কর্মজীবন শেষ করেন।
এই দীর্ঘ কর্মময় জীবনে অগণিত শিশুর চিকিৎসা করেছেন, শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে গেছেন। অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর অন্তর করেছেন আলোকিত। ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, বন্ধুস্বজন সবার জন্য, যার যেখানে প্রয়োজন, নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন।
এর পাশাপাশি তিনি তাঁর ভাইবোনদের নিয়ে তাঁদের মা-বাবার পুণ্য স্মৃতি রক্ষার্থে নিজ গ্রামে ‘মুসা-নূরজাহান মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। ফাউন্ডেশনের অধীনে একটি শিশু হাসপাতাল পরিচালনা করেন, যা এখনো গ্রামের দরিদ্র শিশুদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতাল ছড়াও ফাউন্ডেশনের অধীনে বৃত্তিমূলক শিক্ষা, সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হাঁস-মুরগির খামার, মৎস্য চাষ ও অন্যান্য প্রকল্প চালু করেছেন দুস্থ গ্রামবাসীর কর্মসংস্থান এবং তাদের কল্যাণের জন্য। মানুষ তার কর্মের মাঝেই বেঁচে থাকে, আমাদের প্রিয় স্যার চৌধুরী বি. মাহমুদও বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মের মাঝে। আমরা যারা শিশুচিকিৎসায় নিয়োজিত, আমাদের অনেকেরই অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন অধ্যাপক চৌধুরী বি. মাহমুদ। স্যার নিজে আলো হয়ে জ্বলেছেন, আবার অন্যদের হূদয়কেও আলোকিত করেছেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিভিন্ন বিষয় আছে, যেখানে রোগ সম্পর্কে জেনে রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু শিশুদের চিকিৎসা একটু অন্য রকম, সেটা সবাই জানেন। যে শিশু কথা বলতে পারে না বা নিজের কষ্ট বোঝাতে পারে না, তার কষ্ট হূদয় দিয়ে অনুভব করে তাকে চিকিৎসা করতে হয়, তার সঙ্গে শিশুর উৎকণ্ঠিত মা-বাবাকেও মানসিকভাবে সহায়তা করতে হয়। তাঁদের আবেগ, তাঁদের অনুভূতিও বুঝতে হয়। এই স্পর্শকাতর জটিল কাজটি স্যার কত অনায়াসে করতেন, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। যে পারে, সে বোধ হয় এমনি করেই পারে ফুল ফোটাতে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ছাত্রী হিসেবে স্যারকে দেখেছি প্রথম, স্যার অনেক যত্ন নিয়ে পড়াতেন। সবার দিকে সমান খেয়াল রাখতেন, রোগী দেখতেন হূদয় দিয়ে। স্যারকে দেখে মনে হতো ডাক্তার হলে এমন ডাক্তারই হতে হবে। পাস করে শিশু বিভাগে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় স্যারের সঙ্গে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন শিশু বিভাগে দুজন শিক্ষক ছিলেন, অধ্যাপক হামিদ শেখ ও সহযোগী অধ্যাপক বি. মাহমুদ স্যার। আমি একমাত্র সহকারী রেজিস্ট্রার। সংগত কারণেই আমাকে কাজ করতে হতো হামিদ শেখ স্যারের সঙ্গে। কয়েক দিন পর স্যার আমাকে নিয়ে হামিদ শেখ স্যারের রুমে গেলেন। বললেন, ‘হামিদ ভাই, তাহমীনা আমাদের দুজনের সঙ্গেই রাউন্ডে থাকুক, সব রোগী সম্বন্ধে তার ধারণা থাকা দরকার...।’ স্যার এ কাজটি করেছিলেন হাসপাতালে ভর্তি শিশুরা যাতে সমানভাবে চিকিৎসাসেবা এবং যত্ন পায়। মাঝেমধ্যে একসঙ্গে দুজন রোগী দেখতেন। কোনো জটিল রোগী ভর্তি হলে হামিদ শেখ স্যারের সঙ্গে আলোচনা করতেন। সন্ধ্যায় ওয়ার্ডে কোনো রোগী খারাপ থাকলে ফোন করতাম, স্যার চেম্বার ফেলে তাড়াতাড়ি চলে আসতেন। কী অপূর্ব সৌহার্দ্যপূর্ণ কাজের পরিবেশ ছিল সেই দিনগুলোতে!
১৯৮৪ সালের একসময় আমি তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। স্যার ওয়ার্ডে রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে দেখে যান, একদিন রাতে শ্বাসকষ্ট আরও বেড়ে গেল, আমাকে স্যালাইন, অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। স্যার আমার মাথার কাছে চেয়ারে বসে আছেন। বসে থাকলেন শ্বাসকষ্ট না কমা পর্যন্ত। এত বছর পরও এই দৃশ্য মনে হলে আমার চোখ ভেসে যায় জলে। একজন ছাত্রী, একজন অধস্তন সহকর্মীর প্রতি এত মমতা, এত সহমর্মিতার বোধ আর কারও আছে কি না, আমি জানি না।
একবার রমজান মাসে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনে এফসিপিএস পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষা শেষ হতে হতে প্রায় বিকেল, স্যার বললেন, ‘চলো, আজ তোমাদের বাসায় ইফতার করব।’ স্যার এলেন আমার সঙ্গে সত্যি সত্যি, বিশেষ কোনো আয়োজন ছিল না, তবু সবার সঙ্গে তৃপ্তি করে ইফতার করলেন। এখনো মনের ভেতর আফসোস হয়।...স্যারকে একদিন ভালোভাবে আপ্যায়ন করতে পারলাম না, যদি একদিন সুযোগ পেতাম—সেই সুযোগ আর আসেনি।
২০০৯ সালের ৭ এপ্রিল তিনি এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। স্যার, শেষ পুরস্কার আপনার আমাদের হূদয়ের অর্ঘ্য, ভালোবাসার বিনম্র শ্রদ্ধা।
তাহমীনা বেগম
tahmina_birdem@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.