সমুদ্রসীমা মামলা-মিয়ানমারের সঙ্গে জিতেছি, ভারতের সঙ্গেও জিতব by এম শাহ আলম

আমার উচ্চতর গবেষণাকর্ম সমুদ্র আইন বিষয়ে, সুনির্দিষ্টভাবে সমুদ্রে উপকূলীয় রাষ্ট্রের এখতিয়ারের সীমাসংক্রান্ত, যদিও তা শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণবিষয়ক নয়। তাই আমি ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইনবিষয়ক জাতিসংঘ কনভেনশনের প্রয়োগ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ও কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছি।


ষাট ও সত্তরের দশক ছিল একতরফাভাবে উপকূলীয় রাষ্ট্র কর্তৃক সমুদ্রে নিজেদের এখতিয়ার বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এমতাবস্থায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৭৩ সালে আরম্ভ হয় সমুদ্র আইন পরিবর্তনবিষয়ক সম্মেলন, যার অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের (Territorial Waters) সীমা প্রচলিত ৩ নটিক্যাল মাইল থেকে বাড়িয়ে ১২ নটিক্যাল মাইল করা এবং উপকূলীয় ভিত্তিরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সার্বভৌম অধিকারসহ একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (Exclusive Economic Zone—EEZ) ঘোষণা করা, যেখানে মহীসোপানও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রীয় সমুদ্র (Territorial Waters) ও সামুদ্রিক অঞ্চল (Martine Zones) আইন পাস করে, যেখানে সম্মেলনের উপকূলীয় রাষ্ট্রের এখতিয়ারসংক্রান্ত প্রতিপাদ্য বিষয় প্রতিফলিত হয়। তবে মিয়ানমার ও ভারত এই আইনের বিষয়ে আপত্তি জানায়। ১৯৮২ সালে গৃহীত জাতিসংঘ সমুদ্র আইনবিষয়ক কনভেনশন থেকে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের আইনের সঙ্গে এটির ভিন্নতা কম। তবে আমাদের সমুদ্রের গভীরতা পদ্ধতিতে উপকূলীয় ভিত্তিরেখা টানা, যেখান থেকে সমুদ্রসীমা গণনা শুরু হয়, তা কনভেনশন গ্রহণ করেনি।
১৯৮২ সালের কনভেনশনে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার তিন রাষ্ট্রই স্বাক্ষর করেছে, যদিও অনুসমর্থন করেছে বিভিন্ন সময়। যা হোক, এ সময় বাংলাদেশের প্রধান করণীয় ছিল কনভেনশনের আলোকে অনতিবিলম্বে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে তার সমুদ্রসীমা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য কনভেনশনে দুটি পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে। (১) সমদূরত্ব (Equidistance) পদ্ধতি ও (২) ন্যায়পরতা (Equity) পদ্ধতি। আমাদের উপকূল ভঙ্গুর, পরিবর্তনশীল ও অবতল (concave) হওয়ার কারণে ন্যায়পরতা পদ্ধতিই শুধু গ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে উত্তল (convex) উপকূলের ভারত ও মিয়ানমার এর ঘোর বিরোধী।
১৯৭৪ সালেই বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমায় কয়েকটি ব্লকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এবং তারা কাজও আরম্ভ করেছিল। কিন্তু ভারতের প্রতিবাদের মুখে সে কাজ অব্যাহত রাখা যায়নি। ১৯৮২ সালের পর থেকে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির সব আলোচনা ব্যর্থ হয়। ভারত ও মিয়ানমারকে কখনোই ন্যায়পরতা নীতির ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণে রাজি করানো যায়নি, যদিও বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমারের উপকূলীয় অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য এ নীতির জন্য প্রকৃষ্ট, যা শুধু কনভেনশনের ভাষা ও ভাব থেকেই প্রতীয়মান নয়, বিগত প্রায় ৫০ বছরে ১৯৬৯ সালের জার্মানি, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডের মধ্যে আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক নিষ্পন্ন North Sea Continental Shelf মামলাসহ আন্তর্জাতিক আদালত বা আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত কর্তৃক নিষ্পন্ন অনেক মামলার রায় দ্বারাও সমর্থিত।
২০০৮-০৯ সালে বাংলাদেশ কর্তৃক ঘোষিত কয়েকটি ব্লকে ভারত বিশেষ করে মিয়ানমারের গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানকাজ এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের প্রবল আপত্তি এবং সে অনুযায়ী কূটনৈতিক তৎপরতার মুখে মিয়ানমার তার কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
এ সময়ই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার পাবে। এই ঘোষণাটি আমাদের সবাইকে উৎসাহিত করে। বিষয়টি দেখার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিও গঠন করা হয়েছিল, যদিও তার কার্যক্রম পরবর্তী সময়ে আর খুব একটা শোনা যায়নি।
২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আমি উল্লিখিত বিষয়টি ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করি, এবং আরও লিখি যে এ সমস্যা নিয়ে কমোডর (অব.) খুরশেদ আলম ডেইলি স্টার-এ অনেক নিবন্ধ লিখেছেন, এবং এ বিষয়ে জনগণ ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। জানতে পারি, তিনি এ বিষয়ে একটি মূল্যবান বইও লিখেছেন, যা আমরা অনতিবিলম্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুষদ লাইব্রেরির জন্য সংগ্রহ করি।
আমি বুঝলাম বাংলাদেশে এমন একজন বিশেষজ্ঞ আছেন, যাঁর মধ্যে সমুদ্রসীমা সমস্যা নিরসনে আইনগত ও কারিগরি দক্ষতা রয়েছে, এবং যিনি তাঁর সেই দক্ষতা দেশের জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত। শুধু তা-ই নয়, তিনি বুঝতে পেরেছেন এ নিয়ে জনমত সৃষ্টি, জনগণের ঐকমত্য গঠন এবং সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে ভালোভাবে বোঝানো প্রয়োজন।
আমরা খুবই খুশি হয়েছি যখন জানলাম কমোডর খুরশেদ আলমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমুদ্র আইন বিভাগের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এ জন্য সরকার, বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ।
সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য প্রথম পদ্ধতি হচ্ছে সমদূরত্ব নীতি, যা সহজ ও গতানুগতিক। কিন্তু যেখানে ন্যায়পরতা নীতি আবশ্যিকভাবে প্রযোজ্য হতে হবে, তা ব্যাখ্যা ও নজিরের মাধ্যমে প্রমাণ করার প্রয়োজন। আইন, কারিগরি জ্ঞান ও জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে তা করতে হবে। এ ছাড়া ঐতিহাসিক স্বত্ব, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ তো আছেই। এটি বঙ্গোপসাগর (Bay of Bengal), মিয়ানমার বা ভারতীয় উপসাগর নয়।
আমাদের মনে হয়েছে, কমোডর খুরশেদ আলম এ ব্যাপারে করণীয় কী, তা সরকারকে বোঝাতে পারবেন। পরে জানতে পেরেছি, ২০০৩-০৪ সালে প্রায় সাত বছর আগেই নৌবাহিনীর এই মেধাবী কর্মকর্তাকে তৎকালীন সরকার বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। যার ফলে তিনি কখনোই আর রিয়ার অ্যাডমিরাল বা ভাইস অ্যাডমিরাল হওয়ার সুযোগ পাননি। পরে তিনি লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন এবং তাঁর বিষয়ে অনেক লেখালেখি করতে থাকেন। তাঁর প্রতি অবিচারই হয়ে উঠল জাতির প্রতি সুবিচার! ধর্মের কল এভাবেই বোধহয় নড়ে। পরে কমোডর খুরশেদ আলমকে অবসরেই রিয়ার অ্যাডমিরালের র‌্যাংক প্রদান করা হয়।
২৫ মার্চ প্রথম আলোতে প্রকাশিত মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে এক অনলাইন সাক্ষাৎকারে হামবুর্গে আমাদের একজন অন্যতম কৌঁসুলি পায়াম আকাভান বলেন, ‘খুরশেদ আলম দেশ ও জনগণের প্রতি ব্যতিক্রমীভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি মামলার বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ এবং গভীর জ্ঞানসম্পন্ন। তিনি না হলে এই মামলার ফল অবশ্যই এতখানি বিশিষ্টতা পেত না।’
ইতিহাস ও আইন আমাদের পক্ষে জেনেই বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালের অক্টোবরের প্রথম দিকে বিরোধটি আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়, যদিও আলোচনার দ্বার রুদ্ধ করা হয়নি। সে অনুযায়ী ভারত ও মিয়ানমারকে আনুষ্ঠানিক চিঠি প্রদান করা হয়। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তারা সালিসি প্রস্তাব গ্রহণ না করে পারেনি। মামলা দায়েরে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছিল সাহসী ও দূরদর্শী।
সালিসি আদালত আনুষ্ঠানিকভাবে বসার আগেও ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে নিষ্ফল আলোচনা অব্যাহত থাকে। এ সময় (৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১) প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খান সম্পাদকীয় কলামে লিখলেন, ‘অমীমাংসিতই থাকবে সমুদ্রসীমা?’ শিরোনামে। এটি হতাশাগ্রস্ত পুরো জাতিরও জিজ্ঞাসা ছিল।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য হামবুর্গে সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্যদিকে ভারত হেগে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতেই নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকে।
আমার বিশ্বাস, রিয়ার অ্যাডমিরাল খুরশেদ আলম যেভাবে বিশেষজ্ঞদের কাছে সমস্যাটি তুলে ধরেছেন, সে কারণেই আমরা জেমস ক্রফোর্ড ও ফিলিপস স্যান্ডসের মতো বিশ্বখ্যাত বিশেষজ্ঞদের আমাদের কৌঁসুলি হিসেবে পেয়েছি। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, যিনি আইন বিষয়েও স্নাতক ও রিয়ার অ্যাডমিরাল খুরশেদ আলম যেভাবে ব্যাপারটি এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তা জাতির জন্য উৎসাহব্যঞ্জক।
মিয়ানমারের সঙ্গে বিজয় সালিসি আদালতে বাংলাদেশ-ভারত মামলার রায়ে নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলবে, যে রায় প্রদান করা হবে ২০১৪ সালে। এ ছাড়া ইটলসের তিনজন বিচারকই পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট সালিসি আদালতের সালিসকার। অনেক আগেই তাঁদের সালিসকার নির্বাচনে বাংলাদেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে।
হামবুর্গ ট্রাইব্যুনাল ও হেগের সালিসি আদালতের চরিত্র ভিন্ন হলেও সালিসি আদালত একই নীতি ও পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন। আন্তর্জাতিক আইনের এটাই বিধান। গত প্রায় ১০০ বছরে আন্তর্জাতিক সালিসি ট্রাইব্যুনাল ও আদালতের রায়গুলোই আন্তর্জাতিক আইনের উৎসভান্ডারকে অধিকতর সমৃদ্ধ করেছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমানাবিরোধ একই প্রকৃতির হওয়ায় সালিসি আদালতের রায়ও অনুমান করা যায়।
একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, যদি কোনো পররাষ্ট্র বিষয়ে বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সদিচ্ছা ও সাহস থাকে, উপযুক্ত দেশীয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হয় এবং বিষয় সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা ও ঐকমত্য থাকে, তাহলে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক বিষয়েই বাংলাদেশের অধিকতর সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।
 এম শাহ আলম: চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত), আইন কমিশন।

No comments

Powered by Blogger.