সদরে অন্দরে-অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা by মোস্তফা হোসেইন

'লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে'-বাল্যশিক্ষায় এই অমর বাণী পড়েছিলাম শৈশবে। মুখস্থ করতে হয়েছিল তোতাপাখির মতো। বুঝতে পারিনি, কেন এই শিক্ষা। পরে মনে হয়েছে, আসলে শিক্ষাকে বিত্তের উৎস হিসেবে মনে করে এমনতর বাক্য আমাদের পড়ানো হতো। বিভিন্ন অভিধায় এই বাক্যকে ব্যাখ্যা করা যায়।


হতে পারে, ওই সময় দরিদ্র সমাজব্যবস্থায় ওই চিন্তাই ছিল বাস্তবতা। কিন্তু ব্যত্যয় ঘটে সেই মতেরও। আমাদের জানা ছিল না, কেউ কেউ লেখাপড়া শিখে গাড়ি-ঘোড়া চড়ায়ও। সেই চড়ানোটা যে কখনো কখনো মানুষের ওপর দিয়েও হতে পারে, এতসব চিন্তা করার ক্ষমতা শৈশবেই কারো থাকে না। আমাদেরও ছিল না। এমন শিক্ষিত লোকও পাওয়া যায়, যিনি উচ্চতর শিক্ষা নেওয়ার পরও মানুষ চড়ানোটাকেই নিজের উত্তম পথ বলে মনে করেন।
কিন্তু যিনি প্রয়োজনের তাগিদে গাড়ি-ঘোড়া ব্যবহার করেছেন এবং নিজে শিক্ষাও লাভ করেছেন, তাকে কিন্তু আমাদের প্রকৃত মানুষ ভাবতে মোটেও দ্বিধা হয় না। তার মানে, শিক্ষাকে কেন্দ্র করে অনায়াসেই আমরা বলে দিতে পারি, মানুষ শিক্ষা লাভ করে সুশিক্ষিত হয়। মানুষ শিক্ষা লাভ করেও অমানুষের স্বভাব অর্জন করে কিংবা মানুষ গোড়া থেকেই কুশিক্ষা অর্জন করে। অর্থাৎ, অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও প্রকৃত শিক্ষা_এই তিন ভাগে শিক্ষাকে আমরা অনায়াসেই ভাগ করতে পারি।
শিক্ষাকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি এভাবে_'পড়তে জানা এবং লিখতে জানা হলো শিক্ষা'। যিনি লিখতে কিংবা পড়তে জানেন না, তাঁকে আমরা বলি অশিক্ষিত (যা বাস্তবসম্মত নয়)। অথচ তাঁকে বলা যায় নিরক্ষর। কিন্তু তিনি স্বশিক্ষিতও হতে পারেন। আবার ইউনেস্কো শিক্ষিতের সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে_'চিনতে পারা, বুঝতে পারা, সৃজনশীলতা, যোগাযোগ করতে পারা, ব্যাখ্যা করা, গুনতে পারা এবং মুদ্রিত ও লিখিত বিষয় বোঝা ও পড়ার ক্ষমতা আছে যার, তাকে শিক্ষিত বলা হয়। এর সঙ্গে চলমান জ্ঞান চাহিদা, এক থেকে অন্যের পার্থক্য নিরূপণ করার ক্ষমতা, লক্ষ্য অর্জনের ক্ষমতা, জ্ঞানের বিস্তার করা এবং ব্যক্তি থেকে বৃহত্তর সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন করার সম্পর্ক রয়েছে।' ইউনেস্কোর সংজ্ঞা অনুযায়ী শিক্ষিত ব্যক্তির সংগতকারণেই পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার প্রয়োজন আছে। আর তিনি কখনো অনৈতিকতাকে আমলে আনতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবেই অশিক্ষা মানে বিপরীত বৈশিষ্ট্যকেই বোঝানো হতে পারে। শিক্ষা মানুষকে পূর্ণতা দেয়, কিন্তু নিরক্ষরতা মানুষকে পূর্ণতা না দিলেও নিরক্ষর মানেই অশিক্ষিত নয়। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও মানুষ স্বশিক্ষিত হতে পারে। বাংলাদেশের গ্রামের নিরক্ষর মানুষ ছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তাঁর। কিন্তু পাণ্ডিত্য বিবেচনায় বাংলাদেশের গুটি কয়েক মানুষকে তাঁর সমতুল্য মনে করা যায়। অতি উচ্চমার্গের এমন ব্যক্তিকে শতভাগ পূর্ণ মানুষ হিসেবে সমাজে সবাই স্বীকারও করে। তাঁর দর্শনচিন্তা পাশ্চাত্যের বহু নামিদামি দার্শনিকের সঙ্গে তুল্য।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পর যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে গুলি করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করে বলে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়, তখন সেই সার্টিফিকেটধারীকে কি উচ্চশিক্ষিত বলা যায়? নব্বইয়ের দশকে আমাদের ঢাকায় সেই প্রমাণ পাওয়া গেছে। শুধু সেটাই নয়, এমন প্রমাণ আরো অনেক আছে। দু-একটি উদাহরণ আরো দেওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শ্রেণীতে পড়াকালেই যিনি সাত খুনের অপরাধে শাস্তি পান, সেই ব্যক্তিই যখন রাজনৈতিক সুবিধা পেয়ে এমপি কিংবা রাজনৈতিক নেতা বনে যান, তাঁকে কি শিক্ষিত কিংবা উচ্চশিক্ষিত বলার সুযোগ আছে? শুধু তাঁকেই কেন, যে ব্যক্তিটি হয়তো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডিস্টিংশন মার্ক নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে বিদেশ থেকেও উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত হন, কিন্তু পেশাগত জীবনে মানবসেবার পরিবর্তে বাণিজ্যচিন্তাকেই প্রাধান্য দেন, রোগীরা তাঁকে কসাই হিসেবে চিহ্নিত করে। সেই উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসককে কি প্রকৃতই উচ্চশিক্ষিত বলার সুযোগ আছে?
শিক্ষা নিয়ে এত নেতিবাচক কথা বলার মানে এই নয়, আমাদের এখানকার সব মানুষই কুশিক্ষা কিংবা অশিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত। অবশ্যই তা নয়। আমাদের এখানে অনেক সুশিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি আছেন। তাঁরা স্পষ্টতই নিজেদের তেমনটি দাবিও করতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সেসব ব্যক্তির অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তাঁদের মূল্যবান সেবা পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। ব্রেইন ড্রেইন বলে একটি কথা তাঁদের ব্যাপারে প্রচলিত। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সেসব সোনার ছেলের কোন কারণে দেশ ছেড়ে দেওয়ার এই প্রবণতা তৈরি হয়।
এই ব্রেইন ড্রেইন নিয়েও চলে কত না অনাচার। একটি চক্র গড়ে উঠেছে দেশে। তারা বিদেশে শিক্ষার সুযোগ দেওয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে বেশুমার টাকাও হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব প্রতারক কিন্তু কুশিক্ষার উদাহরণ তৈরি করে, আর প্রতারিতরা বঞ্চিত হয় সুযোগ থেকে।
দেশে তাঁদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়াটা একটি কারণ। তাঁদের সেবা গ্রহণের মতো পরিবেশও নেই দেশে। উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি আন্তর্জাতিকতাকে গ্রহণ করেন। কিন্তু দেশ আন্তর্জাতিক মানে পেঁৗছতে পারে না। বিপরীত বাস্তবতা একজন সুশিক্ষিত মানুষকে বিদেশমুখী করে। তাই শিক্ষার দুর্ভিক্ষ চলছে_এমনটি বলারও অবকাশ নেই আমাদের দেশে। দেশের শিক্ষিতদের অনেকেই এখনো মা, মাটি ও মানুষকে তাঁদের জীবনের অন্যতম পাথেয় হিসেবে মনে করেন। আমাদের দেশে আজ শিক্ষার দুর্ভিক্ষ চলছে বলে যে অভিযোগ কেউ কেউ করেন, তাঁরা হয়তো অনেকেই জানেন না, শিক্ষার ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আমাদের এ অঞ্চলের নাম আসে। তখনকার ভারতবর্ষ, মেসোপটেমিয়া, ইরান এবং মিসরেই প্রথম শিক্ষার প্রসার ঘটে। এরপর শুরু হয়েছে গ্রিসে। আজ আমাদের ভাবা দরকার, সেই ভারতবর্ষ তথা বাংলা-ভারত উপমহাদেশের অন্তর্গত বাংলাদেশ শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে থাকে কেন? আর আজ আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা কোন কারণে মেধা বিকিয়ে দিতে চায়? এসব কারণ উদ্ঘাটন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে আশা করা যায়, দেশ আবারও হারানো সেই ঐতিহ্য ফিরে পাবে।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.