নারী উন্নয়ন নীতি-দেশটাকে ওদের হাতে চলে যেতে দেবেন না by আবদুল মান্নান

লেখার শুরুতে বলে নিই, আমি একজন মুমিন (বিশ্বাসী) এবং নিজেকে কোনো অংশে কারও চাইতে দুর্বল মুসলমান মনে করি না। ইসলামের সব ফরজ মেনে চলার চেষ্টা করি, স্বজ্ঞানে কোনো খারাপ কাজের অংশীদার হই না, শতভাগ হালাল আয় দিয়ে জীবনযাপন করার চেষ্টা করি। ইসলাম নিয়ে যৎসামান্য পড়ালেখা করি।


এক জায়গায় ধর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমার তফাত আছে বলে মনি করি এবং তা হচ্ছে আমি কখনো ফেরেববাজি করি না বা করার চেষ্টাও করি না। ফেরেববাজির সহজ অর্থ প্রবঞ্চনা, শঠতা ও দাগাবাজি। সুতরাং, কোনো অর্থেই আমিনীর মতো মানুষ আমাকে ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করতে পারবেন না। এবং কে মুরতাদ আর কে বিশ্বাসী, তার বিচারের মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা, আমিনীরা নন। শুরুতে এত সব কথা বলার কারণ, ৪ এপ্রিল সরকার-ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১, শিক্ষানীতি এবং হাইকোর্টে দেওয়া ফতোয়াবিরোধী রায়ের (রায়টি এখনো সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন) বিরুদ্ধে আমিনী ও তাঁর দোসরদের ডাকা সহিংস হরতাল সম্পর্কে দু-একটি কথা বলা। এর আগে পাঠকদের সামনে একটি সত্য ঘটনা তুলে ধরতে চাই। ঘটনাটি সত্য, শুধু নাম কটি কাল্পনিক।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে কলি কয়েক বছর আগে ভালো ফলাফল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নামকরা বিভাগ থেকে পাস করেছিল। কলিরা দুই বোন। কলি ছোট। অনেকটা সহায়-সম্বলহীন। বাবা মারা গেছেন আগে। মা অসুস্থ। মা ঠিক করলেন, কখন কী হয় বলা যায় না, সময় থাকতে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে যেতে পারলে মরেও শান্তি পাবেন। বিয়ে ঠিক হলো এক প্রতিষ্ঠিত পরিবারের ছেলের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কাবিননামা হবে সাত লাখ টাকার। বিয়ের দিন বর আসতে অনেক রাত করল। বরপক্ষ এসে জানিয়ে দিল যে সাত লাখ নয়, কাবিন হবে তিন লাখ, যার মধ্যে দুই লাখ টাকা হবে স্বর্ণ বাবদ উশুল। অনেকটা অসহায় এবং জিম্মি কলির পরিবার রাজি হয়ে বিয়েটা দিয়ে দিল। বিয়ের পর দেখা গেল, কলির বর ঠিকমতো বাসায় ফেরে না, অনেক সময় দু-তিন দিন নিরুদ্দেশ থাকে। কলি এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে কোনো সদুত্তর তো মেলেই না, মেলে চড়-থাপড় আর নানা ধরনের দৈহিক নির্যাতন। বিয়ের মাস দেড়েকের মাথায় কলি স্বামীর বাড়ি ছেড়ে মায়ের কাছে চলে আসে। এর মধ্যে মা তাঁর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া পুরান ঢাকার একটি অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে উঠেছেন। অনেকটা মেয়ের এই অসহায়ত্ব দেখে কিছুদিনের মধ্যেই মায়ের মৃত্যু হয়। কিছুদিন আগে কলির সঙ্গে তার স্বামীর ডিভোর্স হয়ে গেছে। যে ভবনে কলির মায়ের অ্যাপার্টমেন্ট, সেই একই ভবনে কলির অন্যান্য আত্মীয়স্বজনও থাকে। এখন তাদের কথা, একলা একজন কলির একটা পুরো অ্যাপার্টমেন্ট কী প্রয়োজন? ওপরে ছোট একটা আছে। সেখানে উঠে যাওয়ার জন্য এখন তার ওপর অসম্ভব চাপ। এমন ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। হরহামেশাই ঘটছে। মানুষ তা জানতে পারছে না।
ওপরের ঘটনার মতো ঘটনা যাতে বন্ধ হয়, সে লক্ষ্যে সরকার গত ৭ মার্চ মন্ত্রিসভায় জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১ পাস করে এবং পরদিন বিশ্ব নারী দিবসে তা ঘোষণা করে। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালে আরও যুগোপযোগী একটি নারীনীতি ঘোষণা করা হয়েছিল, যা চারদলীয় জোট সরকার এসে বাতিল করে দেয়। কোনো ভালো জিনিসই জোট সরকারের তেমন একটা পছন্দ ছিল না। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটা নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করেছিল, তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। যে নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে আমিনীদের এত আস্ফাালন, তা কিন্তু কোনো আইন নয়, একটা নীতি বা গাইডলাইন।
আমিনীরা যে কওমি মাদ্রাসা থেকে পড়ালেখা করে এসেছেন বা যাঁরা এখানে লেখাপড়া করেন, তাঁরা হয় আইন ও নীতির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে অক্ষম অথবা বুঝলেও বিষয়টা নিয়ে সাধারণ জনগণকে বোকা বানাতে এবার ফেরেববাজির আশ্রয় নিয়েছেন।
প্রস্তাবিত নারীনীতিতে ভূমিকা, পটভূমিসহ সর্বমোট ৪৯টি ধারা আছে; যার মধ্যে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, নারী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কন্যাশিশুর উন্নয়ন, নারীর কর্মসংস্থান, নারীর খাদ্যের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে। ২৩ নম্বর ধারায় আছে, ‘জাতীয় অর্থনীতির সকল কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয় ও সম-অধিকার নিশ্চিতকরণ’ ও ২৫ নম্বরে আছে, ‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’। আমিনীরা এ দুটি ধারাকে পবিত্র কোরআনবিরোধী আইন আখ্যা দিয়ে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে শেখ হাসিনা ও সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় লাফিয়ে পড়লেন। বললেন, ‘সরকার আইন করেছে যে সম্পত্তিতে মেয়ে ও পুরুষকে সম-অধিকার দিতে হবে। সরকার পবিত্র কোরআন শরিফে বর্ণিত উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে ছেলে ও মেয়েকে সম্পত্তির সমান ভাগ দিতে বলেছে।’ কোথায় পেলেন আমিনী এমন আজগুবি তথ্য? আমিনীর জানার জন্য বলি, বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশে (মরক্কো, তিউনিশিয়া, সেনেগাল) ইতিমধ্যে এমন আইন করা হয়েছে। নারী উন্নয়ন নীতির ২৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নারীকে শুধু নারী বলে জাতীয় অর্থনীতির কোনো কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা যাবে না অথবা তার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। আর ২৫.২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি ও বাজারব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।’ এর অর্থ, নারী উল্লিখিত সব সূত্র থেকে যে সম্পদ পাবে, তাতে ইচ্ছা করলেই আপনি জোরপূর্বক ভাগ বসাতে পারবেন না। অন্য কেউও না। প্রথমে যে কলির কাহিনি উল্লেখ করেছি, এমন ঘটনা রোধের জন্যই এই আইন করা হয়েছে। তার পরও কি এসব বন্ধ হবে? না, হবে না। তার কারণ, আমাদের সমাজে পুরুষেরা অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। যেখানে আইন দিয়ে নারীদের স্বার্থ রক্ষা করা কঠিন, সেখানে এটা তো একটা নীতি। তার ওপরে আছেন আমিনীরা, যাঁদের কথায় কিছু মানুষ তো সর্বক্ষণ বোকা হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে।
ধর্ম গেল বলে আমিনীরা জিগির তুললেন। তাতে প্রধান বিরোধী দল নৈতিক সমর্থন দিয়ে বাতাস দিল। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে একেবারেই নগণ্য একজন ব্যক্তি ফজলুল হক আমিনী বলিয়ান হলেন এবং হরতাল ডেকে ৪ এপ্রিল তাঁর অনুসারীদের নিয়ে কাফনের কাপড় গায়ে চড়িয়ে এবং কোনো কোনো জায়গায় পবিত্র কোরআন গলায় বেঁধে, তাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আল্লাহর পবিত্র কিতাবকে অপবিত্র করলেন। এটি চরম নিন্দনীয় ঘটনা।
আসলে এসব করে আমিনীরা কী হাসিল করতে চান? তাঁরা শান্তির ধর্ম ইসলামকে বিশ্ববাসীর কাছে জঙ্গিবাদের ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। তাঁরা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানিয়ে প্রস্তর যুগে ফিরিয়ে নিতে চান, তাঁরা এ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার অজুহাতে পাশ্চাত্যের পরাশক্তির অনুপ্রবেশ সহজ করতে চান। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যাঁরা যুদ্ধাপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচার যাতে না হয়, তাঁরা সেই ব্যবস্থা করতে চান, বাংলাদেশকে তাঁদের পিতৃভূমি পতিত রাষ্ট্র পাকিস্তান বানাতে চান। শান্তির ধর্ম ইসলাম বাংলাদেশে আজ কিছু ফেরেববাজ, ধান্ধাবাজের হাতে জিম্মি হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সত্যিকারের সাম্য আর শান্তিবাদী মুসলমানরাই এদের কবল থেকে ইসলামকে রক্ষা করতে পারেন। নিজামী-আমিনীদের হাতে ইসলাম কখনো নিরাপদ নয়। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে জনগণ কোনো বামনাকৃতির ওসামা বিন লাদেন বা মোল্লা ওমরের উত্থান দেখতে চায় না। তা যাতে না ঘটে, তা দেখার দায়িত্ব প্রধানত সরকারের।
নারীনীতি নিয়ে আমিনীদের ফেরেববাজি রুখতে সরকার এবার যথেষ্ট সজাগ ছিল বলে মনে হয় না। আমিনীরা যখন এই নীতি নিয়ে পানি ঘোলা করছিলেন, সরকারের প্রচারযন্ত্র ছিল অনেকটা নিষ্ক্রিয়। ৪ এপ্রিল রাতে একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী পুরো বিষয়টাকে নিয়ে একটা চমৎকার ব্যাখ্যা দিলেন। এমন ব্যাখ্যা তো প্রতিদিন দেওয়া উচিত ছিল। বিটিভিতে হয়তো দিয়েছেন। তবে বিটিভি আসলে কজনে দেখে, সেটিও ভাবার বিষয়। হরতালের দিন আমিনীর সৈনিকেরা ফজরের নামাজ পড়েই বিভিন্ন জায়গায় রাজপথ দখলে নিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসেছে আরও পরে। আবারও সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার চরম ব্যর্থতা। হরতাল ডাকার অজুহাত হিসেবে আমিনী শিক্ষানীতি আর হাইকোর্টের দেওয়া ফতোয়াবিরোধী রায়কেও দাঁড় করিয়েছেন। শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কারণ, সেই নীতিতে সরকার কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ন্ত্রয়ণের কথা বলেছে। এ কারণেই আমিনীদের গাত্রদাহ। ৪ এপ্রিলের পর এটি বাস্তবায়ন এখন ফরজ হয়ে পড়েছে। মাদ্রাসার কোমলমতি বালকদের কাছে মানুষ গজারি কাঠের লাঠি ও লোহার রডের বদলে বই-খাতা দেখতে চায়। আর ফতোয়ার বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। এটি নিয়ে মন্তব্য করলে আদালত অবমাননা হতে পারে।
বাংলাদেশ জঙ্গিবাদীদের একটি অভয়ারণ্য—এমন অপবাদ থেকে বর্তমান সরকারের আমলে আমরা সরে এসেছিলাম। আমিনীরা আর বেশি লম্ফঝম্ফ করলে সেই অপবাদ ফিরে আসতে বেশি সময় লাগবে না। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ভয়ানকভাবে ক্ষতি হবে। প্রধান বিরোধী দলের প্রতি বিনীত অনুরোধ, আপনাদের মধ্যে নিশ্চয় কিছু বিচক্ষণ ও বিবেকবান ব্যক্তি আছেন। জেনেশুনে আমিনীদের আশকারা দিয়ে আপনারা যদি লাভবান হবেন বলে মনে করে থাকেন, তাহলে নিশ্চিতভাবে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এমন ভুল আপনাদের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জিয়াউর রহমান করেছিলেন। লাভ হয়নি কিছুই। দেশটাকে ওদের হাতে চলে যেতে দেবেন না। দেশটি সবার।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.