বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট-গবেষণায় বাড়তি বরাদ্দ চাই by একরামুল হক শামীম

ছাত্ররাজনীতির প্রভাব, সেশনজট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান কমিয়ে দিচ্ছে বটে। কিন্তু কেবল এগুলোর কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে থাকতে পারছে না এমন ধারণা ভুল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কতটা গবেষণা হয় তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?


অথচ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সম্প্রতি দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবারের বাজেট ২৭৭ কোটি ২৯ লাখ টাকার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ৮৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ১১৫ কোটি ৬০ লাখ টাকার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ২৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকার এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ১৮০ কোটি ১৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকার। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট পাসের খবর আমাদের পত্রিকাগুলো খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে ছাপেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক, সংবিধান সংশোধন, জাতীয় বাজেট এসব নানা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ভিড়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট নিয়ে আলোচনা করার ফুরসতই-বা কোথায়! কোনো বছরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট নিয়ে ওইভাবে বিশ্লেষণ হতে দেখা যায় না। বিরোধিতা করে কোনো ধরনের মন্তব্য, পত্রিকায় প্রকাশিত কলামও খুব একটা চোখে পড়ে না। অথচ জাতীয় বাজেট যেমন দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা দেয়, ঠিক তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট দেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
২০১১-১২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট বিশেল্গষণ করা যাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট বাজেটের ৭৯.৩৪ শতাংশ রাখা হয়েছে বেতন-ভাতা ও পেনশন খাতে। মোট বরাদ্দের মাত্র ১১ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয়ের জন্য রাখা হয়েছে। এই ১১ শতাংশের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ গবেষণা খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে আয়ের উৎসে বর্ধিত আয়ের জন্য বেতন-ফি বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নতুন অর্থবছরের জন্য শিক্ষার্থীদের বেতনসহ বিভিন্ন ফি উৎসের আয় ধরা হয়েছে ১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। গত বছরের তুলনায় এটি প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা বেশি। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের ওপর এতে চাপ বাড়বে। আগের তুলনায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় বাড়বে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের ০.৮৯ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে গবেষণা, শিক্ষা সরঞ্জাম ও রাসায়নিক খাতে। যথারীতি সেখানেও শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনের জন্যই বরাদ্দের সিংহভাগ অংশ। এ খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৮ কোটি ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অথচ গবেষণা, শিক্ষা সরঞ্জাম ও রাসায়নিক দ্রব্য ক্রয়ের খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৭৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের সর্বাধিক বরাদ্দ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে। এ খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। পাশাপাশি পেনশন খাতে বরাদ্দ ১৫ কোটি টাকা। শিক্ষা খাতে ব্যয় হবে মাত্র ১৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যার মধ্যে মাত্র ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে গবেষণার জন্য। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দেওয়া বরাদ্দ অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জন্য ৪৫ লাখ টাকায় গাড়ি কেনা হচ্ছে। অবাক করা বিষয় হলো, উপাচার্যের গাড়ির তুলনায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতের বরাদ্দ প্রায় ৬ গুণ কম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাজেটেরও সর্বোচ্চ বরাদ্দ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে। এ খাতে বরাদ্দ ২০ কোটি ৮ লাখ টাকা। শিক্ষা আনুষঙ্গিক খাতে বরাদ্দ ৪ কোটি টাকা। এসব বাজেট প্রস্তাব থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ই সর্বোচ্চ বরাদ্দ রেখেছে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশন খাতে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক কম, গবেষণা খাত তো তারও পরের ব্যাপার। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশন খাতে বরাদ্দ বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যান্য খাতের বরাদ্দের তুলনায় সেটি কত বেশি হবে সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ২০১০ অর্থবছরে বেতন-ভাতা ও পেনশন খাতে মোট বাজেটের ৪৮ শতাংশ খরচ করেছিল। হার্ভার্ডের মতো এত বড়মানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে বেতন-ভাতা ও পেনশন খাতে বরাদ্দ ৪৮ শতাংশ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন এ খাতে মোট বাজেটের ৮০ শতাংশ বরাদ্দ করতে হয় সেটিই বড় প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে সব খাতেই বরাদ্দ যৌক্তিক করা জরুরি। বেতন-ভাতা-পেনশন খাত থেকে বরাদ্দ কমিয়ে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি।
একটা অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে, সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংগুলোতে স্থান হচ্ছে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের। ছাত্ররাজনীতির প্রভাব, সেশনজটসহ নানা ধরনের কারণ হাজির করা হয় এর পেছনে। কিন্তু আসল কারণটি খুব কম মানুষই বলে। ছাত্ররাজনীতির প্রভাব, সেশনজট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান কমিয়ে দিচ্ছে বটে। কিন্তু কেবল এগুলোর কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে থাকতে পারছে না এমন ধারণা ভুল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কতটা গবেষণা হয় তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? অথচ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ যদি কেবল শিক্ষার্থীদের পড়ানোই হয় তাহলে স্কুলের সঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য কোথায় থাকে?
সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে একসময় দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত এশিয়া উইকের র‌্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৩৭তম। ২০০০ সালে ছিল ৬৪তম। অথচ এখন সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতেও এ দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এখনকার সময়ে তিনটি জনপ্রিয় র‌্যাংকিং হচ্ছে সাংহাই জিয়াও টং ইউনিভার্সিটির ওয়ার্ল্ড একাডেমিক র‌্যাংকিং অব ইউনিভার্সিটিস, দ্য টাইমসের হায়ার এডুকেশন সাপিল্গমেন্টের ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং এবং নিউজউইক ম্যাগাজিনের টপ হান্ড্রেড গ্গ্নোবাল ইউনিভার্সিটিস। এই র‌্যাংকিংগুলো নির্ধারণ করার হিসাব দেখলেই পরিষ্কার হবে কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতটা পিছিয়ে। সাংহাই জিয়াও টং ইউনিভার্সিটির ওয়ার্ল্ড একাডেমিক র‌্যাংকিং অব ইউনিভার্সিটিস নির্ধারিত হয় ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে। ৩০ শতাংশ নির্ভর করে ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই এবং স্টাফদের নোবেল প্রাইজ অথবা গণিতে অবদানের জন্য ফিল্ড মেডেল জেতার ওপর। ৬০ শতাংশ নম্বর প্রকাশিত আর্টিকেল এবং বিভিন্ন প্রকাশনায় উদ্ধৃতি ব্যবহারের ওপর। বাকি ১০ শতাংশ নম্বর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের আকারের ওপর। নিউজউইক ম্যাগাজিনের র‌্যাংকিং করা হয় শিক্ষাব্যবস্থা, গবেষণা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক অনুপাত, লাইব্রেরি সুবিধা, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সুযোগের বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য রেখে। এখন পর্যন্ত করা ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ের মধ্যে টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংটিকেই সবচেয়ে ভালোমানের বিবেচনা করা হয়। ২০১০-এর ১৬ সেপ্টেম্বর সপ্তমবারের মতো সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে টাইমস। ১৩টি ভিন্ন ভিন্ন ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় রেখে সেরার তালিকা নির্ধারণ করা হয়েছে। মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে র‌্যাংকিং বিবেচনা করা হয়েছে। এগুলো হলো_ শিক্ষা প্রদান : শিক্ষাক্ষেত্রের পরিবেশ (শতকরা ৩০ ভাগ), গবেষণা : সংখ্যা, আয় ও গুণগত মান (শতকরা ৩০ ভাগ), গবেষণা সহায়তা : গবেষণা কাজে ভূমিকা রাখা (৩২.৫ ভাগ), নতুনত্ব : শিক্ষাক্ষেত্রের নতুনত্বের বিকাশ (শতকরা ২.৫) ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল : শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা (শতকরা ৫ ভাগ)। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার গুরুত্ব এসব র‌্যাংকিংয়ের মানদণ্ড থেকেই পরিষ্কার। টাইমস র‌্যাংকিংয়ের ৬২.৫ শতাংশ নম্বর নির্ভর করে গবেষণার ওপর। আর এ জন্যই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই র‌্যাংকিংয়ে স্থান পাচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট অধিবেশনে চেয়ারম্যানের বক্তৃতায় উপাচায় অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, 'উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খাতে ব্যয় বাড়ালে তা কোনো অবস্থাতেই অপচয় বিবেচিত হতে পারে না। সবসময়ই তা লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হয়।' অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটি কেবল কথার ফলঝুরি। কারণ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাড়েনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৭১ লাখ ৭০ হাজার টাকা, যেখানে বেতন-ভাতা ও পেনশন খাতে ব্যয় হবে ২২০ কোটি এক লাখ টাকা। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থাও একইরকম। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান বাড়বে কীভাবে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি মৌলিক কার্যক্রম হচ্ছে গবেষণা। অথচ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিন দিন এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা থেকেও পিছিয়ে পড়ছে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়। বিষয়টি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট প্রণেতা কর্তৃপক্ষ যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই তা মঙ্গলজনক হবে।

একরামুল হক শামীম : সাংবাদিক
samim707@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.