আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী-শিক্ষক প্রহার ও র‌্যাবের দুঃখ প্রকাশ by শেখ হাফিজুর রহমান

এবার র‌্যাবের আক্রমণের শিকার হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এক র‌্যাব সদস্যের প্রহারে গুরুতর জখম হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থব্যবস্থা বিভাগের প্রভাষক মো. সাইফুদ্দিন খান। মুঠোফোনে মো. সাইফুদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেছেন, গত ২৮ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে গাওয়াইয়ের বাসা থেকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য


তিনি গাড়ি ভাড়া করতে যান। তিনি গলির মুখে থাকা র‌্যাবের গাড়ি সরানোর জন্য গাড়িচালক ল্যান্স করপোরাল নুরুল আমিনকে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি ‘তোর এত বড় সাহস, র‌্যাবের গাড়ি সরাতে বলিস’ বলেই তাঁর ওপর চড়াও হন এবং তাঁকে মারতে থাকেন। এতে তাঁর ডান হাতের কনুইয়ের হাড় ভেঙে গেছে। তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। ঘটনার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অহিদুজ্জামান তীব্র নিন্দা জানান। ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করে। এ ব্যাপারে র‌্যাবের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা করে ওই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি প্রদানের আশ্বাস দেন। এদিকে গত ২ এপ্রিল নরসিংদী-মদনগঞ্জ সড়কের খাটেহারা নামক স্থানে ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে নাহিদ মোল্লা ও আরিফ মিয়া এসএসসি পরীক্ষার্থী। পরিবারের দাবি, তারা ছিল নির্দোষ।
দেশের প্রথম ‘এলিট ফোর্স’ হিসেবে গঠিত হওয়ার পর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সন্ত্রাস নির্মূলসহ নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। দীর্ঘদিনের নানা সন্ত্রাস ও মারাত্মক অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নির্মূল করে র‌্যাব যেমন মাঠপর্যায়ের সাধারণ মানুষের ‘ত্রাণকর্তা’ হয়ে প্রশংসা পেয়েছে—বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, কোনো কোনো র‌্যাব সদস্যের চাঁদাবাজি ও ডাকাতি; তেমনি র‌্যাবের গায়ে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী’ ও ‘রাষ্ট্রের পেটোয়া বাহিনী’র তকমা এঁটে দিয়েছে। আর দিন দিন যে প্রশ্ন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে সেটি হলো, অপরাধ ও সন্ত্রাস কঠোর হস্তে দমন করার জন্য যে এলিট ফোর্সের জন্ম, সেটি কি শেষ পর্যন্ত এক ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে উঠবে? র‌্যাব সদস্যের গুলিতে কলেজছাত্র লিমনের পা কেটে ফেলা, র‌্যাব কর্মকর্তাদের হাতে নিরপরাধ বাপ্পী, মহিউদ্দিন ও নূর আলমের প্রাণ হারানো, চট্টগ্রামের তালসরা দরবার শরিফ থেকে দুই কোটি টাকা লুটের ঘটনায় র‌্যাব-৭-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল জুলফিকার আলী মজুমদারসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা, গত ২৮ মার্চ র‌্যাব সদস্যের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের জখম হওয়া কী ইঙ্গিত দেয়?
২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র‌্যাব গঠিত হয় ভয়াবহ সব সন্ত্রাস ও অপরাধ দমন করার জন্য। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন র‌্যাবের সদস্য সংগ্রহ করা হয় পুলিশ, সেনা, নৌ ও আকাশবাহিনী থেকে। প্রথম থেকেই র‌্যাবের পোশাক, অস্ত্র ও অঙ্গভঙ্গিতে সবাইকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা ছিল। র‌্যাব সদস্যদের গায়ে কালো পোশাক, মাথায় বাঁধা কালো কাপড়, চোখে কালো চশমা ও হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রের মাধ্যমে সবার মধ্যে ভীতি সঞ্চারের চেষ্টাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক—আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা তত্ত্বাবধায়ক, র‌্যাবের হন্তারক কর্মকাণ্ডে কোনো ছেদ পড়ছে না। জন্মের পর থেকে র‌্যাব এক হাজারের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনের অভিযোগ। ২০১০ সালের মার্চে র‌্যাবের মহাপরিচালক যে হিসাব দেন, সে অনুযায়ী, র‌্যাবের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ এ পর্যন্ত ৬২২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। র‌্যাবের কাছে যা ‘ক্রসফায়ারে’ মৃত্যু, মানবাধিকার সংগঠনের কাছে তা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। আইন অনুযায়ী বিচার বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড ছাড়া রাষ্ট্রের কোনো সংস্থার তো কাউকে খুন করার এখতিয়ার নেই। অথচ র‌্যাব সেই কাজটিই করে চলেছে। তালিকাবদ্ধ সন্ত্রাসীদের শাস্তি প্রদানে বিচার বিভাগের দুর্বলতার কথা বলে ‘ক্রসফায়ার’কে জায়েজ করার চেষ্টা চলে। অথচ তালিকাবদ্ধ সন্ত্রাসীদের নিঃশেষ করার পরও দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যখন কোনো উন্নতি হয় না, তখন আমরা অবাক হই। যে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনের জন্য র‌্যাব গঠিত হয়েছে, র‌্যাবের মাধ্যমে তা করতে চাইলে র‌্যাবকে জবাবদিহিহীন পাগলা ঘোড়া হতে দিলে চলবে না। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নস (সংশোধন) আইন, ২০০৩ অনুযায়ী র‌্যাব গঠিত হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এখন পর্যন্ত র‌্যাব পরিচালনার জন্য রুলস বা বিধিমালা তৈরি করতে পারেনি। র‌্যাব প্রতিষ্ঠাকালে এর নিজস্ব কোনো গঠনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অ্যাক্ট অনুযায়ী র‌্যাব পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। র‌্যাবের সঙ্গে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের পার্থক্য করতে এই অ্যাক্টের দুটি ধারায় পরিবর্তন আনা হয়। পরিবর্তিত ধারাগুলো মামলা তদন্ত এবং অপরাধ ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করাসংক্রান্ত। এ দুটি ধারা পরিবর্তন করে র‌্যাবকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়। অ্যাক্ট থাকলেও বিধিমালা না থাকায় প্রায়ই আদালতে র‌্যাবকে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। (দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ এপ্রিল ২০১১)
জঙ্গি দমন ও নৃশংস কিছু অপরাধ দমনে র‌্যাবের প্রশংসনীয় সাফল্য সত্ত্বেও র‌্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, র‌্যাবের সব ভালো কাজ এতে খারিজ হয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, ২০০৪ সালে জন্মের পর থেকেই রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যেই র‌্যাবের ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড চলছে। এদিকে র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে। ডাকাতি ও লুটতরাজের জন্য র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত হয়েছে।
সমপ্রতি এক র‌্যাব সদস্য নির্মমভাবে প্রহার করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে। আর নরসিংদীতে দুই নির্দোষ এসএসসি পরীক্ষার্থীকে মেরে ফেলার অভিযোগ উঠল র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে। ছিনতাই, ডাকাতি, নানা রকম ও মাত্রার সন্ত্রাসে আমরা অতিষ্ঠ। এর সঙ্গে যদি র‌্যাবের আগ্রাসী আচরণ, ব্ল্যাকমেইলিং, চাঁদাবাজি ও ডাকাতি যুক্ত হয়, তাহলে আমরা যাব কোথায়? জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনের জন্য আমরা শক্তিশালী র‌্যাব চাই। কিন্তু র‌্যাবের নামে আমরা জবাবদিহিহীন কোনো বাহিনী চাই না। আমরা চাই না র‌্যাব হয়ে উঠুক এক ফ্রাংকেনস্টাইন।
 শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.