পাহাড়ধস-থামানো যাবে না?

বর্ষা মৌসুম শুরুর প্রাক্কালে প্রতি বছরের মতো এবারও সমকালসহ প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে পাহাড় ধসের আশঙ্কা নিয়ে বেশ কয়েকটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। সিলেট-চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সচিত্র প্রতিবেদনই শুধু নয়, সম্পাদকীয় কলামে উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
গণমাধ্যমের এমন আশঙ্কা ও সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগের পরও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটল। চট্টগ্রামের বাটালী হিলে প্রাণ দিল ১৫ জন মানুষ। বেদনাদায়ক হলেও বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের ঘটনা এখন প্রতি বছরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলেই জানেন, বৃক্ষ-বেষ্টনীবিহীন, ক্ষয়প্রাপ্ত পাহাড় বৃষ্টির পানিতে ধসে পড়তে পারে। তারপরও কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না, ছিল না ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার কার্যকর উদ্যোগও। কর্তৃপক্ষ মাইকিং করে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছিল বলে জানা গেছে। হাতেগোনা কিছু মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়াও হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। পাহাড়ের পাদদেশে বাস করে লক্ষাধিক মানুষ। এভাবে যে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বাটালী হিলের বিয়োগান্ত পাহাড়ধস সে কথা প্রমাণ করে দিল। চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে বাস করে নিম্নআয়ের মানুষ। বিকল্প বাসস্থানের সংস্থান নেই বলেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে এমন আবাসস্থল বেছে নিয়েছে তারা। শুধু মাইকিং করে তাদের সরে যেতে উৎসাহিত করা এক ধরনের অবাস্তব উদ্যোগ বটে। এসব মানুষ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের অসহায় শিকার। পাহাড় ধসের তাৎক্ষণিক কারণ প্রাকৃতিক হলেও একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় ধসের কারণ মানুষের তৈরি। স্বার্থান্বেষী মহল পাহাড় কেটে বসতির জায়গা তৈরি করেছে, পাহাড় থেকে মাটি কেটে জমি ভরাট করেছে, পাহাড়কে গাছগাছালিমুক্ত করে ধস ত্বরান্বিত করা হয়েছে। পাহাড়ের ভূমি আর স্থির থাকতে পারছে না। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নেমে আসছে। আবার স্বার্থান্বেষী মানুষগুলোই ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে বসতি তৈরি করে নিম্নআয়ের মানুষদের কাছে ভাড়া দেয়। মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে রাখতে কোনো দ্বিধা নেই, যদি নিজেদের প্রাপ্য পকেটে ওঠে। ২০০৭ সালের ১১ জুনের ভয়াবহ পাহাড় ধসে ১২৫ জন নিহত হওয়ার পর গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজসহ সমাজের নানা পর্যায় থেকে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ করার দাবি উঠেছিল। তখন গঠিত হয়েছিল দুটি তদন্ত কমিটি। কমিটি অনুসন্ধান করে ১৮টি কারণ চিহ্নিত করেছিল। পাহাড়ধস ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ঠেকাতে ৩৬ দফা করণীয়ও ধার্য করেছিল। ইতিমধ্যে ৪টি বছর কেটে গেছে। এ পর্যন্ত ৩৬ করণীয়র একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। এ কয় বছরের পরিস্থিতির অবনতি বৈ উন্নতি হয়নি। এ কথা সত্য, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত লক্ষাধিক মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া কঠিন ব্যাপার। কিন্তু সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো থেকে মানুষ সরানোর উদ্যোগও বিগত বছরগুলোতে এতটুকু এগোয়নি। বরং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোগের কারণে একের পর এক পাহাড় বিলুপ্ত হয়েছে। আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। আর যে পাহাড় টিকে আছে তাও খোরাক হয়েছে লোভীদের। অথচ ভূমিবৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিদ্যমান পাহাড়গুলো সংরক্ষণ করা অত্যাবশ্যক। জরুরি এসব বিষয় দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানের কর্তাদেরও নজরে এ যাবৎ আসেনি। ফলে জলাবদ্ধতা বেড়েছে, নাজুক পাহাড়ের সংখ্যা বেড়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হয়েছে আর বেড়েছে মানুষের জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি। সুপারিশ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে বনায়ন করে, গাইড ওয়াল নির্মাণ করে, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে সেগুলোকে রক্ষা করার; কিন্তু আদতে পাহাড় রক্ষার কোনো উদ্যোগই আসেনি। বাটালী হিলের ধসের পর আবারও বিষয়গুলো সামনে এসেছে। কিন্তু বর্ষা পেরোলেই যথারীতি পাহাড়, পাহাড়ধস ও আহত-নিহতদের ভুলে যান সকলে। আমরা মনে করি, এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতির বদলে এবার পাহাড় ও মানুষ রক্ষার উদ্যোগ আসা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.