মানবাধিকার-পুলিশ পাহারায় লিমনের চিকিৎসা! by আমীন আল রশীদ ও খান মো. রবিউল আলম

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কাঁদছেন। তাঁর গলা ভারী হয়ে আসছে। তিনি কথা বলতে পারছেন না। এইচএসসি পরীক্ষার্থী লিমন ও তার পরিবারের অসহায়ত্বকে ছাপিয়ে ড. মিজানুর রহমানের এই অসহায়ত্বের রূপ সারা দেশের মানুষ টেলিভিশনের খবরে দেখেছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা আর মানবাধিকার পরিস্থিতি একটি বিশেষ বাহিনী কোন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেটি বোঝার জন্য এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন প্রতিনিয়তই বলছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। এমনকি গত ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় সংসদের বৈঠকেও তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। আর লিমনের পায়ে র‌্যাবের গুলি করার ঘটনাটিও ঘটে সে দিনই। অর্থাৎ লিমনের ট্র্যাজেডি আর মন্ত্রীর কমেডি মঞ্চায়িত হয়েছে একই সঙ্গে।
ঘটনাটি প্রথম ছাপা হয় প্রথম আলোয় ৬ এপ্রিল। প্রথম পৃষ্ঠায় বক্স আকারে ‘চরম নিষ্ঠুরতা’ শিরোনামের এই সংবাদে বলা হয়েছে, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের দিনমজুর তোফাজ্জল হোসেনের ছোট ছেলে লিমন। কাঠালিয়া পিজিএস কারিগরি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী সে। গত ২৩ মার্চ বিকেলে লিমন মাঠ থেকে গরু আনতে বাড়ির বাইরে যায়। পথে স্থানীয় শহীদ জমাদ্দারের বাড়ির সামনে র‌্যাবের একটি দল তাকে সামনে পেয়ে শার্টের কলার ধরে নাম জিজ্ঞেস করে। লিমন নিজেকে ছাত্র বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু র‌্যাবের এক সদস্য কথাবার্তা ছাড়াই তার বাঁ পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে দেন। পঙ্গু হাসপাতালে আনলে চিকিৎসকেরা তার পা কেটে ফেলে দেন।
তবে এই নির্মম ঘটনা নিয়ে আগের মতোই বক্তব্য দিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাবের আইন ও জনসংযোগ শাখার পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এ রকম একটি পরিস্থিতিতে যেকোনো পক্ষের কেউ আহত বা নিহত হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে কেউ নিহত হয়নি, একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।’
ড. মিজানুর রহমান মানবাধিকারকর্মী ও সংবেদনশীল মানুষ। কিন্তু তাঁর কান্নার মধ্য দিয়ে মূলত মানবাধিকার কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক অসহায়ত্বই ফুটে উঠেছে। তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বলেছেন, লিমনের ঘটনা সারা দেশের অসহায়, দরিদ্র ও দুঃখী মানুষের মানবাধিকার চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনাটি খতিয়ে দেখার জন্য। আমরা সবাই জানি, এ ধরনের তদন্ত কমিটির কাজ ও এর ফলাফল কী হয়? এই মর্মান্তিক ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা কী হবে, তা আমরা জানতে পারিনি।
লিমন এখনো পুলিশ পাহারায়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ খরচ করে লিমনের চারপাশে পাহারা বসানো হয়েছে। কী অদ্ভুত কর্মযজ্ঞ! দোর্দণ্ড প্রতাপে যখন অনেক সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ নাকের ডগায় ঘুরে বেড়ায়, তখন লিমন পুলিশবেষ্টিত। গুরুতর আহত ও পা হারানো লিমনের পাহারায় পুলিশ বসানো হলেও যারা তাকে গুলি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অতীতেও লিমনের মতো অনেকে কোনো অপরাধ না করেও র‌্যাব-পুলিশের হাতে নিগৃহীত হয়েছে। অনেকে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। কিন্তু কোনো বিচার হয়নি। কেউ অপরাধ করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু বিচারের আগেই তাকে শাস্তি দিতে পারে না।
তবে লিমনের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে এ রকম নিরীহ মানুষের নির্যাতনের ঘটনা আকসার ঘটছে। সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না। লিমনের ঘটনাটি দেশের শীর্ষ দৈনিক গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে বলেই এটি নিয়ে এখন সারা দেশে এত আলোচনা। ধরে নিচ্ছি, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তিও হবে। কিন্তু দিনমজুরের ছেলে কিশোর লিমনের ভবিষ্যৎ কী। সে কি তার হারানো পা-টি ফিরে পাবে? সে কি আর পড়ালেখা করতে পারবে? যে স্বপ্ন নিয়ে সে বেড়ে উঠছিল, সেই স্বপ্ন কি সে আর দেখার সাহস পাবে? সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি তার যে ঘৃণা তৈরি হলো, সেটি কি কখনো মুছবে?
আমরা জানতে চাই, লিমন কত বড় সন্ত্রাসী। র‌্যাবের হাতে যদি পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ থাকে, তাহলে তারা একটি সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে জানাক যে লিমন আসলেই সন্ত্রাসী এবং পায়ে গুলি করার মতো দুর্ধর্ষ। আর যদি র‌্যাব সেটি না পারে, তাহলে তারা অন্তত এটুকু স্বীকার করুক যে তারা ভুল করে লিমনকে গুলি করেছে এবং ভবিষ্যতে তারা এমন ভুল আর করবে না।
শেষ খবর হলো, লিমনের মা ছয় র‌্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আইজিপি বলেছেন, লিমনের ঘটনা র‌্যাবই তদন্ত করবে। যেখানে র‌্যাব কর্মকর্তারা অভিযুক্ত, সেখানে তাদের হাতে তদন্তভার দিলে সঠিক তথ্য বের না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সে ক্ষেত্রে অন্য সংস্থা দিয়ে পুরো ঘটনাটি তদন্ত করা হোক—এটাই আমাদের দাবি।
আমীন আল রশীদ ও খান মো. রবিউল আলম: গণমাধ্যমকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.