শেয়ারবাজার-টাকা জমাতে শুরু করুন, প্লিজ by এ কে এম জাকারিয়া

‘আমি বলেছিলাম, তদন্ত প্রতিবেদনটি জনসমক্ষে প্রকাশ করব। এখন সেটি প্রকাশ করা হবে না। হয়তো কিছু ব্যক্তির নাম এসেছে। এগুলো ডিলিট করে (বাদ দিয়ে) প্রকাশ করব।’ সরকার যা চাইবে অর্থমন্ত্রীকে তো তা-ই করতে হবে! শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত হিসেবে তদন্ত প্রতিবেদনে যাঁদের নাম এসেছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।


যে নামগুলোর ‘ভয়ে’ অর্থমন্ত্রী আগের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছেন, সে নামগুলো কি শেষ পর্যন্ত অজানাই থাকল? নাকি থাকবে? পত্রপত্রিকায় ও টেলিভিশনে নামগুলো আসছে। সমস্যাটা আসলে নাম প্রকাশ নিয়ে নয়, নামগুলো আমরা জেনেই গেছি। নাম প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার আসলে আমাদের কী জানাতে চাইল? ভেবেচিন্তে মনে হলো, সরকারের সংকেতটা আসলে প্রতিবেদনে নাম আসা প্রভাবশালীদের প্রতি, অনেকটা এ রকম, ‘চিন্তা কোরো না, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।’ সরকার তো তাঁদের সঙ্গেই থাকবে, এটাই তো নিয়ম!
দেশের কয়েক লাখ বিনিয়োগকারীকে (‘ক্ষুদ্র’) বলি, আপনারা কি জানতেন না যে আপনারা ‘ক্ষুদ্র’? বড় মাছ যে ছোট মাছদের খেয়ে ফেলে, এটা আপনাদের অজানা ছিল? এটাও কি জানেন না যে, বড় মাছেরা আপনাদের মতো ছোট মাছ খেয়ে এতই ফুলে-ফেঁপে ওঠে যে, কোনো জাল দিয়েই তাদের ধরা যায় না? এসব বড় মাছের সঙ্গে একই নদীতে খেয়ে-পরে বাঁচবেন—এমন ধারণা আপনাদের কী করে হয়েছিল? ভুল তো আপনারাই করেছেন! ভুলের মাশুল আপনারা দেবেন না তো কে দেবে? এই মাশুলটা ২০ হাজার কোটি টাকা! একটু বেশি হয়ে গেল কি? তবে এই টাকা তো আর আপনার একার টাকা নয়, লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর টাকা, ভাগেজোগে আর কত পড়বে! বিষয়টি মেনে নিন, শান্তি পাবেন!
তবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এই পরামর্শ মেনে নেবেন—এমন ভরসা পাওয়া কঠিন। মনে হয়, এই শান্তি তাঁরা চান না। ‘শান্তি’ বিষয়টি তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই। কিছু হবে না জেনেও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের আশায় ছিলেন অনেকে। টাকা না হয় গেছে, কিন্তু কারা তা লুটেপুটে খেল, সরকার অন্তত এটুকু জানিয়ে তাদের দায়িত্ব সারবে। সরকারের মুখ থেকে এই নামগুলো শুনে ‘শান্তি’ পেতে চেয়েছিল অনেকে। সরকার এই শান্তিটুকু থেকেও তাঁদের বঞ্চিত করল! ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী হয়ে কী অপরাধই না করেছেন আপনারা!
বাংলাদেশ একটি অনন্য দেশ, দুনিয়ার সব দেশে যা হয় বাংলাদেশে তা হবে কেন? দেশটির অনন্য রূপটিই তো হারিয়ে যাবে তাহলে! আমাদের দেশে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। সংক্ষেপে এসইসি। সারা দুনিয়ায় এ ধরনের কমিশনের কাজ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। বাংলাদেশে এসইসি নিশ্চয়ই সেই একই পথে হাঁটবে না। আপনারা, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এই সহজ বিষয়টি বুঝতে পারলেন না? ঢালতে ঢালতে ২০ হাজার কোটি টাকা ঢেলে ফেললেন! এসইসি ঠিক পথেই হেঁটেছে, তারা বড়দের স্বার্থ রক্ষাকেই নিয়ম মেনেছে। এখন বড়রাও দাঁড়িয়ে গেছেন তাঁদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টায়। তদন্ত প্রতিবেদনে এসইসির মাথার দিকের তিন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই উপদেশ মেনে সরকার যাতে কাজ না করে সে জন্য ‘বড়রা’ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ২০ হাজার কোটি টাকা যাঁরা খুইয়েছেন তাঁদের বলি, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীই যদি হবেন তবে বাংলাদেশে কেন? ‘ক্ষুদ্রদের’ স্বার্থ দেখার তো এখানে কেউ নেই। না এসইসি, না সরকার!
রাজনীতিবিদেরা নাকি অতীত থেকে শিক্ষা নেন না। আপনারা যাঁরা শেয়ারবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, তাঁরাও তো অতীত থেকে শিক্ষা নিলেন না! ১৯৯৬ থেকে ২০১১। ১৫ বছরের মাথায় একই ভুল করলেন। আপনাদের টাকাগুলো তো তখনো গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তদন্ত কমিটি হয়েছিল, অনেকের নাম এসেছিল। যাঁরা টাকা খুইয়েছেন তাঁরা কী টাকা ফেরত পেয়েছিলেন, নাকি দোষীদের শাস্তি দেখে অন্তত শান্তির ঘুম ঘুমাতে পেরেছিলেন! আপনারা নতুন করে যে শেয়ারবাজারে আবার টাকা ঢালছিলেন, সেখানে যে আগের অনেকেই ছিলেন, তা কি আপনাদের জানা ছিল না? নতুন এমন আরও অনেকেরই যে জন্ম হতে পারে, তা কি আপনাদের বিবেচনায় ছিল না? অতীত থেকে শিক্ষা না নিলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। এই ১৫ বছরে জমানো ২০ হাজার কোটি টাকা আবার তুলে দিতে হয়েছে তাঁদেরই হাতে।
পুরোনো প্রসঙ্গ থাক। এবার ভবিষ্যতের কথা বলি। আমরা জানি, ভবিষ্যতের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাও অতীতের কাছ থেকে শিক্ষা নেবেন না। বর্তমান তখন অতীত মাত্র। ২০১০-১১ সালে বর্তমান ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা মাত্র ২০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে পার পেয়েছেন। সামনে অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকার কমে পার পাবেন না। ভবিষ্যতের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা, আপনারা এখন থেকেই টাকা জমাতে শুরু করুন, প্লিজ!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.