সময়ের প্রেক্ষিত-স্বাভাবিক হয়ে আসছে জাপানের নাগরিক জীবন by মনজুরুল হক

ভূমিকম্প, সুনামি ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনা তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জাপানকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে ধরে রেখেছিল। ভূমিকম্পের প্রচণ্ডতা এবং এর ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়ার আগেই শুরু হয় সুনামি-জলোচ্ছ্বাস, যা কিনা ভূমিকম্পের চেয়েও ভয়াল আকার ধারণ করে একে একে গ্রাস করে ফেলে


জাপানের প্রধান দ্বীপ হোনশুর পূর্ব উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন জনপদ। জাপানের টেলিভিশন যখন ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি আর পাহাড়সম ঢেউয়ের প্রচণ্ডতায় বাড়িঘর, গাছপালা, জাহাজ, মোটরগাড়ি, বাস ও ট্রেনের মতো যানবাহন আর দোকানপাটের খেলনা-পুতুলের মতো ভেসে যাওয়ার ছবি প্রচার করার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা তুলে ধরায় ব্যস্ত, অনেকটা ঠিক সময়েই শোনা যায় আরও এক মহা দুর্যোগের পদধ্বনি, অন্য সব খবরকে ছাপিয়ে যা কিনা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে সারা বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত সংবাদ। গত শুক্রবার আবারও ভূমিকম্প জাপানে আঘাত হানলেও তাতে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ফুকুশিমা জেলায় অবস্থিত দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটির শীতলীকরণ-প্রক্রিয়া সুনামির ঢেউয়ের আঘাতে অচল হয়ে পড়া থেকে যে তাণ্ডবের সূচনা, এখন পর্যন্ত সেটা পুরোপুরি আয়ত্তে আনা না গেলেও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া উদ্বেগ যে ছিল প্রকৃত ঘটনার বিচারে অনেকটাই বাড়াবাড়ি, তা এখন ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠছে। সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে প্রচার করে যাওয়া নানা রকম আষাঢ়ে গল্পকে সত্য ধরে নিয়ে অনেকেই তখন তড়িঘড়ি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, সেই তালিকার সর্বোচ্চে আছে আমাদের বাংলাদেশ। জাপান-প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেই ঘটনা বলা যায় অনেকটাই লজ্জায় ফেলে দেয় এবং দেশের নীতিনির্ধারকদের অপরিপক্বতার কল্যাণে যেন বন্ধুরাষ্ট্রের জনগণের সামনে আমাদের হেয় হতে না হয়, অনেকটা সেই তাগিদ থেকেই জাপান-প্রবাসী একদল বাংলাদেশি তেজস্ক্রিয়তার হুঁশিয়ারিকে তোয়াক্কা না করে দুর্গত এলাকার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণকারীদের জন্য দেশি খাবার রান্না করে পরিবেশন করতে শুরু করে। এর সবটাই তারা করেছে নিজেদের সংগ্রহ করা অর্থে। অন্য এক বাংলাদেশি হোটেলমালিক তাঁর দুটি হোটেলের সব রকম বুকিং বাতিল করে দিয়ে হোটেলের দুয়ার ঘরহারা মানুষের জন্য বিনা পয়সায় উন্মুক্ত করে দেন। জাপানের মানুষের দুর্দিনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রদান করা সেই সেবা এখনো অব্যাহত রেখেছেন বাংলাদেশি হোটেলমালিক আখতার হোসেন। এর বাইরে গত রোববার টোকিওতে বাংলাদেশিদের আয়োজিত এক সমাবেশে তাৎক্ষণিকভাবে সংগ্রহ করা প্রায় ১২ লাখ ইয়েন জাপান রেডক্রস সমিতির দুর্যোগ ত্রাণ তহবিলে দেওয়া হয়েছে।
জাপানিদের দুর্দিনে তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করার উদ্দেশ্যে আয়োজিত তহবিল সংগ্রহের সেই অনুষ্ঠানের চমকপ্রদ দিকটি ছিল দল-মতনির্বিশেষে প্রায় সবার এতে উপস্থিত থাকা। বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সেখানে যেমন অর্থ-সাহায্য আয়োজকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, একইভাবে দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক সমিতি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানও উদারভাবে বাড়িয়ে দেয় তাদের সহযোগিতার হাত। প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই বদান্যতা জাপানি পক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। জাপানের সংবাদমাধ্যম প্রচার করেছে, তাদের সেই অবদানের কথা, এমনকি জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রচারিত বিবৃতিতেও এই দিকটির উল্লেখ লক্ষণীয়। ফলে বাংলাদেশ সরকারের প্রচারিত দূতাবাস বন্ধের ঘোষণার মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে সন্দেহের যে বীজ রোপিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, বলা যায় জাপান-প্রবাসী বাংলাদেশিদের নেওয়া তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সম্ভাবনার সেই বীজ থেকে চারাগাছ বের হয়ে আসার পথ এখন বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
সংকট নিরসনে সার্বিকভাবে অগ্রগতি লক্ষ করা গেলেও ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনাকবলিত চারটি চুল্লি থেকে তেজস্ক্রিয়তা নির্গত হওয়ার প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ করা এখনো সম্ভব হয়নি। এদিক থেকে মিশ্র অক্সাইড বা মক্স ফুয়েল ব্যবহার করা ৩ নম্বর চুল্লি হচ্ছে বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ। পারমাণবিক চুল্লির আংশিক গলে যাওয়া এবং এর থেকে তেজস্ক্রিয়তা বাতাসে ছড়িয়ে পড়া নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত এখন আর নেই। তবে যে প্রশ্নে এখনো মতপার্থক্য বিরাজমান সেটি হলো, মানবজীবনের ওপর তা কতটা হুমকি হয়ে দেখা দেবে।
যাঁরা মনে করেন, এটা আসলেই হচ্ছে মারাত্মক এক হুমকি, শুরুতে তাঁদের সেই মতামত কিছুটা অগ্রাধিকার পাওয়ায় জাপান ছেড়ে বিদেশিদের চলে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল। তবে দুর্ঘটনার তিন সপ্তাহ পর এখন ক্রমেই তেজস্ক্রিয়তার সীমিত প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠায় দেশত্যাগীদের মধ্যে অনেকেই এখন আবার উল্টো পথে ফিরে আসতে শুরু করেছেন এবং অন্য কোনো দূতাবাস নতুন করে বলছে না যে তারা সরে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে টোকিওর জনজীবনে ফিরে আসা স্বস্তিবোধও সীমিত প্রতিক্রিয়ার ধারণার সমর্থনেই প্রমাণ তুলে ধরছে। আর এসব কারণেই জাপানের রসাতলে যাওয়ার খবর প্রচার করে যাওয়া সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি এখন অন্যত্র সরে গেলেও জাপানের দিকে আঙুল উঁচিয়ে রাখা তারা এখন পর্যন্ত বন্ধ করেনি।
পশ্চিমের অনেক সংবাদমাধ্যম এখন জাপান থেকে আমদানি হয়ে আসা পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি আলোচিত হতে থাকায় বিশ্বের ২৫টি দেশ ইতিমধ্যে জাপান থেকে খাদ্য আমদানির ওপর বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে কঠোর নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের, যে দেশটি ইতিমধ্যে জাপান থেকে সব রকম খাদ্যসামগ্রীর আমদানি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
জাপান সরকার অবশ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গ্রহণ করা এ রকম তড়িঘড়ি উদ্যোগে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। জাপানে খাদ্যসামগ্রীর নিরাপত্তা মানদণ্ড এমনিতেই বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর। তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার সংবাদে সরকার খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়ে আরও কিছু পদক্ষেপ ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছে। যেমন—পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঠিক পর পর সরকার ফুকুশিমা এবং এর চারদিকের তিনটি জেলায় উৎপাদিত শাকসবজি ও দুগ্ধজাত পণ্য বাইরে সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে জাপানে যে দূষিত খাদ্য ছড়িয়ে পড়ছে, তা কিন্তু মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। তবে তা সত্ত্বেও আশঙ্কা করা হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের নেতিবাচক প্রচারে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন দেশের গ্রহণ করা পদক্ষেপ সার্বিকভাবে জাপানের খামার পণ্যের রপ্তানিকে প্রভাবিত করবে। আর এ কারণেই জাপানের প্রধানমন্ত্রী নাওতো কান ৪ এপ্রিল টোকিওতে ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি জোসে মানুয়েল বাররোসোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাপান থেকে আমদানি হওয়া খাদ্যসামগ্রী বিষয়ে সুস্থ মাথায় চিন্তাভাবনা করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি যুক্তিসংগত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে ফুকুশিমার দুর্ঘটনাকবলিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে সমস্যা এখন দেখা দিয়েছে তা হলো, পারমাণবিক চুল্লির মূল অংশ এবং সেই সঙ্গে জ্বালানি রড রাখার জলাধারের মাত্রাতিরিক্ত উত্তপ্ত হওয়া বন্ধ রাখতে বাইরে থেকে সমানে যে পানি ঢালা হচ্ছে, তা সেখানে জমা হতে থাকা। আংশিক তেজস্ক্রিয় সেই পানি সরিয়ে ফেলার নানা রকম পন্থা অবলম্বন করা হলেও এর কোনোটাই কার্যকর না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত সরকারের অনুমতি নিয়ে ১১ হাজার টন পানি সমুদ্রে ছেড়ে দিতে শুরু করেছে। জাপান সরকার ও জাপানের পারমাণবিক নিরাপত্তা এজেন্সি অবশ্য বলছে, পানিতে স্বল্প পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা থেকে গেলেও মানবজীবনের জন্য হুমকি হয়ে সেটা দেখা দেবে না। এদিকে জাপান সরকারের প্রধান মুখপাত্র আভাস দিয়েছেন যে ফুকুশিমার দুর্ঘটনাকবলিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয়তা নির্গত হওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে আরও কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।
জাপানের সাম্প্রতিক দুর্যোগ অন্যদিকে আবার দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরুকরণের আভাস দিচ্ছে। প্রধান বিরোধী উদার গণতন্ত্রী দলের নেতা সাদাকাজু তানিগাকি ৪ এপ্রিল বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নাওতো কানের এ মুহূর্তে সংসদ ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচন ডাকা উচিত হবে না। বিরোধী দল অবশ্য দুর্যোগের আগে সরকারের পদত্যাগের দাবি নিয়মিতভাবে জানিয়ে আসছিল। ফলে তানিগাকির মন্তব্য থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে বিরোধীদের সঙ্গে মিলে জাতীয় একটি সরকার গঠনের যে প্রস্তাব ক্ষমতাসীন দল এর আগে দিয়েছিল, প্রধান বিরোধী দল তাকে এখনো পুরোপুরি নাকচ করে দেয়নি। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী কান বিরোধী দলের নেতাকে মন্ত্রিসভায় উপপ্রধানমন্ত্রী ও দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্গঠন উদ্যোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর পদ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.