আর কত দিন নির্যাতকেরা শাস্তির বাইরে থাকবে?-শিশু হাসিনার প্রতি নিষ্ঠুরতা

শিশু হাসিনার জন্য গৃহকর্মীর জীবন আর বন্দিশিবিরের নির্যাতনের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। প্রাণীমাত্রেরই ব্যথা অনুভূত হয়, যত রকমভাবে ব্যথা দেওয়া সম্ভব, তত রকমভাবেই হাসিনা অত্যাচারিত হতো। কঙ্কালসার দেহ বলে তাকে খেতে দেওয়া হতো না।


তার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চিতে জখমের দাগ বলে তার নির্যাতনের কোনো সীমা ছিল না, তার সারা শরীরে ঘা বলে প্রতিদিনের নির্যাতনে তার ঘা শুকানোর সময় পেত না। শরীরেই যার এত আঘাতের চিহ্ন, তার মনে তাহলে কেমন যন্ত্রণা? এসবই চলেছে ১১ বছর বয়সী এক গৃহকর্মীর ওপর, যার মা মরে গেছেন, বাবা ফেলে গেছেন এবং যার কোনো সহায় নেই। এই বর্বরতা যিনি করেছেন বলে অভিযোগ, তিনি এক সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী। সমাজের মানুষ নিশ্চয়ই তাঁকে ভালো জানে। সেই ভালোর তলায় এত যে বর্বরতা, তা হাসিনাকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
গত সোমবারের প্রথম আলোয় হাসিনার দুর্ভাগ্যের বিবরণ ‘এ কেমন নিষ্ঠুরতা!’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগে প্রকাশ, ঢাকা সেনানিবাসের সেই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী শুধু নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হননি, অসুস্থ, মুমূর্ষু মেয়েটির মাথায় কোরআন রেখে এই নির্যাতনের কথা কাউকে না বলার জন্য প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন। তারপর তাকে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসেন তার আরেক গৃহকর্মী বোনের মালিকের বাসার সামনে। সারা রাত সে এভাবে পড়ে থাকার পর সকালে পথচারীরা তাকে পায়।
এ রকম অজস্র গৃহকর্মী প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও হত্যার শিকার হচ্ছে। কারও গায়ে গরম তেল ছিটানো হয়, কাউকে দেওয়া হয় গরম খুন্তির ছ্যাঁকা, কাউকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়। অল্প বয়সী মেয়েদের বেলায় বাড়তি যোগ হয় যৌন নিপীড়ন। যতই নির্মম শোনাক, গৃহকর্মী প্রথাকে যতই আধুনিক নামে ডাকা হোক, অনেক ক্ষেত্রেই তা দাসপ্রথার মতোই নিষ্ঠুর ও বর্বর। এবং এই বর্বর আচরণ যাঁরা করেন, তাঁদের বেশির ভাগই ভদ্র-সভ্য মানুষ হিসেবে পরিচিত। বাইরের এই ‘ভদ্র-সভ্য’ চেহারার তলায় যে কদর্য মানসিকতা লুকিয়ে থাকে, নির্যাতনক্লিষ্ট হাসিনা তার সাক্ষী।
মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন স্বাচ্ছন্দ্য আনতে হাসিনাদের মতো মেয়েদের লাগে। এরা ঠিকমতো মজুরি তো পায়ই না, উপরন্তু থাকতে হয় খাদ্যকষ্টে, সইতে হয় অপমান-নির্যাতন। নির্যাতকেরা গৃহকর্মীদের ঠিক মানুষ মনে করেন না। তাঁদের সেটা মনে করাতে পারত আইন ও আইন রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু সারা দেশে কর্মরত লাখ লাখ গৃহকর্মীর বঞ্চনা-নির্যাতন ও হত্যার শিকার হওয়া থেকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই কারও নেই। অসুস্থ হাসিনার নির্যাতনের ঘটনার বিচার, নির্যাতকদের শাস্তি এবং তার চিকিৎসার খরচ জোগানোর দায়িত্ব এখন সরকারের।

No comments

Powered by Blogger.