চরাচর-বাংলাদেশের গ্রামীণ নারী by মুশতারী বেগম

কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোন রূপকথা নয় সে নয়। জীবনের মধু মাসের কুসুম ছিঁড়ে গাঁথামালার শিশির ভেজা কাহিনী শোনাই শোন।' এটি চমৎকার এবং বিখ্যাত একটি গানের কলি, যেটি শুনলে সুরের মূর্ছনায় হৃদয়ের অলিন্দে অনেক বছর আগের গ্রামীণ নারীদের চিত্র আমাদের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে।

আরো ভেসে ওঠে কিছু চিত্র। যেমন, গ্রামের বধূরা লম্বা ঘোমটা টেনে কাঁখে কলসি নিয়ে ইতি উতি তাকাতে তাকাতে ঘাটে যাচ্ছেন পানি আনতে। তাঁদের পরনে থাকত ডুরে শাড়ি, নীলাম্বরী শাড়ি, পাছা পাড় শাড়ি, নাকে থাকত বড়সড়ো নোলক, পায়ে মল আর কোমরে বিছা। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এই চিত্রটি পাল্টেছে। সেই সময়কার বালিকারাও চঞ্চল ও কোমলমতী ছিলেন। তাঁরাই ছিলেন আমাদের দাদি নানি। ইচ্ছে হলেও তাঁরা বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করতে পারতেন না। কিংবা স্কুল-কলেজে যেতে পারতেন না, ধর্মান্ধতা, সমাজ ব্যবস্থা, গৃহকর্তা ও গ্রামের মাতব্বর শ্রেণীর ব্যক্তিদের শাসনের কারণে তাঁদের অবদমিত ইচ্ছেগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত। ঢেঁকিতে ধান ভানা, ধান সিদ্ধ করে উঠোনে বিছিয়ে দেওয়া, গাভীর দুধ দোয়ানো, মুড়ি-চিড়া ভাজা, সন্তান লালন পালন এগুলো ছিল সেদিনকার সাধারণ গ্রামীণ নারীদের দৈনন্দিন কাজ। গ্রামীণ নারীদের কাজের দক্ষতা ও ধৈর্য অপরিসীম। তাঁদের তৈরি তাঁতবস্ত্র, সিল্কবস্ত্র, মাটির তৈরি তৈজসপত্র ও গহনা, বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্র বাংলাদেশের বড় বড় শপিংমলগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে। কুটির শিল্পে তাঁরা অত্যন্ত পারদর্শী। বিদেশে এসব জিনিস রফতানি করা হচ্ছে এবং বিদেশিদের কাছে এগুলোর অনেক কদর রয়েছে কারণ এসব জিনিসপত্রের স্বকীয় সত্তা রয়েছে এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এ যুগের গ্রামীণ নারীরা অনেক সচেতন। তাঁরা পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। গ্রামীণ নারীরা এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে পরিবারের তথা সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতির উন্নতি সাধন করছেন। আবাদি জমি চাষ করা, আগাছা পরিষ্কার করা, সার দেওয়া ও ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত করছেন। বাড়ির ভেতর সবজি গাছ লাগিয়ে, বিক্রি করে তা থেকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ বের করছেন। বিভিন্ন সমিতি ও এনজিও থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে হাঁস, মুরগির খামার, মাছ চাষ, রিকশা কিনে ব্যবসা করার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই চিন্তা, ধ্যান-ধারণা, আকাঙ্ক্ষা পাল্টেছে। বেশ কিছু গ্রামীণ মহিলা শহরে এসে গার্মেন্ট, শিল্প-কারখানায় কাজ করছেন। বাসাবাড়িতে কাজ নিয়েছেন। দালানকোঠা তৈরির জন্য ইট ভাঙছেন। মুটের কাজ করছেন। সবচেয়ে আশাপ্রদ কথা এই যে গ্রামীণ নারীরা যে সাফল্যের দুয়ারে পেঁৗছে গেছেন এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ তাঁরা বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করে তাঁদের মতামতকে প্রকাশ করতে পারছেন। স্বাস্থ্য পরিচর্যায় সচেতন হয়েছেন। তবে অতীব দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি, কতগুলো ঘৃণ্যতম অপরাধের শিকার হওয়ার করণে তাঁরা অনেক পিছিয়ে পড়ছেন। এর জন্য দায়ী সমাজ ব্যবস্থা, ফতোয়াবাজির শিকার হওয়া, নির্যাতন, বহুবিবাহ, ধর্মান্ধতা, বাল্যবিবাহ, যৌতুকপ্রথা, নারী পাচার, এসিড নিক্ষেপ, শিক্ষাগ্রহণে বাধা এসব নিগ্রহে তাঁরা নিগৃহীতও হচ্ছেন। অতএব, আমরা প্রতিটি সচেতন দেশবাসী বলতে চাই। ১। নারী-পুরুষের সমতা সাংবিধানিক অধিকার। সুতরাং গ্রামীণ নারীদেরও এটি অর্জন করতে হবে। ২। গ্রাম থেকেই বেশির ভাগ নারী পাচার হয়ে থাকে। এটিকে রুখতে হবে। ৩। প্রতিটি গ্রামীণ কন্যাশিশুকে বাসাবাড়িতে কাজ না দিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে। ৪। শহরের নারীদের মতো প্রতিটি গ্রামীণ নারীদেরও পিতা ও স্বামীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তিতে অংশীদারিত্ব থাকতে হবে। ৫। প্রতিটি গ্রামীণ গর্ভবতী মায়েদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যত্নবান হতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামীণ নারী সুখী হোক, পৃথিবীটা হয়ে উঠুক তাঁদের চোখে অনেক অনেক সুন্দর।
মুশতারী বেগম

No comments

Powered by Blogger.