বইপত্র-গণমানুষের যুদ্ধ by মেহেদি হাসান

রাজশাহী ১৯৭১ অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান—সম্পাদক: মুহম্মদ লুৎফুল হক, রাশেদুর রহমান
\ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী \ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন \প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১২ \ মূল্য: ৩০০ টাকা।

একটি যুদ্ধ যখন জনমানুষের যুদ্ধে রূপ লাভ করে, সকল স্তরের, সব শ্রেণী-পেশার মানুষ যখন সেই লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে, তখন সেটাতে জয়লাভ কেবলই সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হলো এমনই এক যুদ্ধ। বহু বহুকাল আগে থেকে ক্রমাগত শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার। একটি রাষ্ট্র থেকে আরেকটি রাষ্ট্রের কাঠামোয় আমরা খুঁজেছি আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ১৯৪৭ সালে এখানকার মানুষ ভেবেছিল, পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রে তারা তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে। সেই আন্দোলনে তাই সমর্থন দিয়েছিল সাধারণ মানুষ। কিন্তু খুব অল্প দিনেই তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের শিকার হতে হয় তাদের। ফলে আবারও রুখে দাঁড়ানো, আবারও প্রতিহত করা। ধর্মের নামে এ দেশের মানুষের ওপর উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র সফলতার সঙ্গেই প্রতিহত করে তারা। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করতে সমর্থ হয় বাংলার মানুষ। এই আন্দোলনের ভেতরই লুকানো ছিল ভবিষ্যৎ প্রতিবাদের সাহস। এই আন্দোলনই প্রকৃতপক্ষে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে বাংলার মানুষকে। ফলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের নিপীড়ন যখন সর্বশেষ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে, তখনই বাংলার মানুষ চূড়ান্ত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সর্বস্তরের মানুষের সমন্বিত প্রতিবাদের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হলো মুক্তিযুদ্ধ। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। সারা পৃথিবীতে এমন ঘটনা বিরল। দেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে প্রতিরোধ আরম্ভ হয়। সমস্ত জায়গায় পাকিস্তানিরা নিরীহ বাঙালিদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। বৃদ্ধ, শিশু, নারী কেউই তাদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায় না। নির্বিচারে শিয়াল-কুকুরের মতো বাঙালিদের হত্যা করে তারা। অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ ও হত্যা করে তারা। নির্বিচারে এমন হত্যার নিদর্শন বাঙালি আর কোনো দিন দেখেনি। ফলে যত বেশি হত্যা ও নির্যাতন করে তারা, প্রতিরোধ তত বেশি দানা বাঁধতে থাকে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষও ঝাঁপিয়ে পড়েছে সশস্ত্র সংগ্রামে। তবে দেশে একটি সামগ্রিক যুদ্ধ চলতে থাকলেও বিভিন্ন স্থানের সংগ্রামের চারিত্র্য ও স্থানিক পরিস্থিতি এক রকম থাকে না। ফলে পুরো যুদ্ধ সম্পর্কে জানার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার যুদ্ধকালীন ইতিহাস জানা জরুরি। রাজশাহী ১৯৭১ অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান বইয়ে বর্তমান রাজশাহী জেলার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এটি মূলত একটি সাক্ষাৎকার গ্রন্থ। তবে এ-জাতীয় অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, সাক্ষাৎকারে প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে পরবর্তী সময়ে যাচাই-বাছাই করে গ্রন্থভুক্ত করা হয়েছে। সাক্ষাৎকারগুলোর বেশির ভাগই ১৯৯৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মলয় ভৌমিক গ্রহণ করেন। সম্প্রতি গ্রহণ করা হয় আরও তিনটি সাক্ষাৎকার, যার মধ্যে দুটি গ্রহণ করেন প্রথম আলো র রাজশাহী প্রতিনিধি আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ। এসব সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে নানা অজানা তথ্য। অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ও ধরা দিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। নানা পেশার, নানা বয়সের মানুষের সঙ্গে কথা বলার ভিত্তিতে রচনা করা হয়েছে বইটি। ১৯৭১ সালে এসব ব্যক্তির কেউ ছাত্র, কেউ শিক্ষক, কেউ সরকারি চাকরিজীবী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ আলোকচিত্রী, কেউ আইনজ্ঞ, কেউবা রাজনীতিবিদ ছিলেন। ফলে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে, নানা স্তরের মানুষের বয়ানে সমৃদ্ধ হয়েছে বইটি। ১৯৭০ সালের নির্বাচন, তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা, সামাজিক প্রেক্ষাপট, একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, রাজাকারদের অত্যাচার, সংখ্যালঘুদের অবস্থা, ভারতের ভূমিকা, শরণার্থী শিবিরের অবস্থা, যুদ্ধের বর্ণনা ইত্যাদি তথ্য উঠে এসেছে এসব আলাপচারিতায়। সাক্ষাৎকারদাতারা এখানে কথা বলেছেন অকপটে, সাবলীলভাবে। আক্রমণকারী সেনাবাহিনী কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর, কতটা আতঙ্কে দুঃস্বপ্নের দিন কাটিয়েছে তাঁরা, শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন কীভাবে অতিবাহিত হচ্ছিল—এসব কথাই বলে গেছেন তাঁরা। সাক্ষাৎকারগুলোর নিবিড় পাঠে বোঝা যায়, সম্ভবত প্রথমে একটি নির্দিষ্ট ছক ছিল সেগুলোর, কিন্তু আলাপচারিতার সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই সব সীমারেখা থাকেনি, কথনসূত্র যেদিকে গেছে সেদিক থেকেই এগিয়েছে আলাপ। সাক্ষাৎকারদাতারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বলেছেন তাঁদের স্মৃতির কথা, আবেগের কথা। এই বই থেকে রাজশাহী যুদ্ধের একটি পৃথক রূপরেখার সন্ধান পাবেন ধীমান পাঠক। মূলত নানা শ্রেণী, পেশা, বয়সের মানুষের এই বয়ানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বহুরৈখিক পাঠ নিতে সাহায্য করবে বইটি।

No comments

Powered by Blogger.