আলোর ইশারা-সমুদ্রে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো by আইনুন নিশাত

সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। যে কারণে বিশ্বের বড় গ্যাস কোম্পানিগুলো এখানে কাজ করতে আগ্রহী। এখন বাংলাদেশ যে ইকোনমিক জোনের অধিকারী হলো সেখানে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান কাজে আর কোনো বাধা থাকল না। একটি বড় কোম্পানি ইতিমধ্যেই ওই এলাকায় দায়িত্ব পেয়েছে।

আমরা আশা করব, এ অনুসন্ধান বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সর্বোচ্চ করার প্রচেষ্টা নেওয়া হবে এবং বাপেক্সকে কাজে লাগানো হবে

বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ মিলেছে ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক আদালতে। এ বিজয়ের কারণে দক্ষিণের সাগরের ওপর আমাদের যে অধিকার হারিয়ে ফেলার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল, তার অবসান ঘটল। পূর্ব দিকে মিয়ানমার এবং পশ্চিমে ভারত তাদের পছন্দমতো সীমারেখা নির্ধারণ করে যে লাইন টেনেছিল, তাতে করে বহিঃসমুদ্রে আমাদের প্রবেশাধিকার থাকছিল না। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তিতে সমুদ্র আইন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল (ইটলস) থেকে যে সিদ্ধান্ত পাওয়া গেছে তাতে বাংলাদেশের সমুদ্রের দিকের পথ খুলে গেছে। নেপালকে বলা হয় স্থলবেষ্টিত বা ল্যান্ডলকড। বাংলাদেশেরও সি-লকড হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। এর আরেকটি কারণ, ২০০ নটিক্যাল মাইল সীমারেখা নির্ধারণে ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো বিচার কাজ হয়নি। সঙ্গত কারণেই এ বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা কী হতে পারে সে বিষয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে এ রায় শুধু বাংলাদেশের বড় অর্জন নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে একটি নজির সৃষ্টি হলো, যা ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা যায়।
এ রায়ে কয়েকটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। প্রথমত, এই ট্রাইব্যুনাল আঞ্চলিক সমুদ্রে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন এবং মহীসোপানের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সীমারেখা নির্ধারণের অধিকারী। ২২ জন বিচারক এ ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। অর্থাৎ ল অব দি সী সংক্রান্ত সব আইনের ব্যাখ্যার ক্ষমতা এই ট্রাইব্যুনালের।
দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল, এই ট্রাইব্যুনাল কি ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপানের সীমা নির্ধারণের ক্ষমতা রাখেন? একুশ বনাম এক ভোটে বিচারকরা সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা সেটা করতে পারেন।
তৃতীয় বিষয়টি ল অব সীর ১৫ ধারা সংক্রান্ত, যাতে কত দূর পর্যন্ত সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হবে সে সম্পর্কে বলা আছে। ট্রাইব্যুনাল লক্ষ্য করে যে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এ বিষয়ে পরস্পর বিপরীত ধারণা পোষণ করে। স্বাভাবিকভাবে এ কারণে ট্রাইব্যুনালকে নজির সৃষ্টিকারী সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
চতুর্থ সিদ্ধান্ত সবচেয়ে জরুরি, যার মাধ্যমে সিদ্ধান্তটি চিহ্নিত করা হয়েছে_ অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ধারণ করে ট্রাইব্যুনাল 'একটি' লাইন টেনেছে। বলা যেতে পারে, 'একটি' লাইন নয়, কয়েকটি সরলরেখার সমন্বয়ে পুরো সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই লাইনটির মোট নয়টি পয়েন্ট রয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৃত অর্জন। একজন বিচারক এ বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেন, কিন্তু বাকি ২১ জন একমত হয়ে রায় দেন।
এর পরের সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, ১০ ও ১১ নম্বর পয়েন্টকে সংযুক্ত করে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমারেখা ঠিক করে দেওয়া। এর বিরোধিতা করেছেন ২২ জনের মধ্যে একজন।
সর্বশেষ বিষয়টি হচ্ছে, ২২ নটিক্যাল মাইল সীমারেখায় পেঁৗছানোর পর বহিঃসমুদ্রে বাংলাদেশের অধিকার সংক্রান্ত। এ ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে ১৯ এবং বিপক্ষে ৩ জন ভোট দিয়েছেন।
এখন দেখা যাক, আদালতের এ রায়ের কারণে কী ধরনের উপকার পাওয়া যাবে। আমরা তিনটি বিষয় প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করতে পারি। প্রথমত, প্রতিবেশীর সঙ্গে একটি ঝগড়া মিটল। দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমা রয়েছে_ ভারত ও মিয়ানমার। নেপাল ও ভুটান আমাদের কাছের প্রতিবেশী, কিন্তু সরাসরি সীমারেখা নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের স্থল ও সমুদ্র সীমারেখা রয়েছে। অথচ এ দেশটি সম্পর্কে আমরা খুব একটা জানি না। ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সঙ্গে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠতা ছিল। বান্দরবানের অধিবাসীরা মিয়ানমারকে খুব কাছের দেশ বলে মনে করে।
মিয়ানমার প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এ দেশটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চায় এবং এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রয়েছে। চীনের কুনমিং প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপিত হলে অর্থনৈতিকভাবে মিয়ানমার ও আমরা উভয় দেশই লাভবান হতে পারব। মিয়ানমারের অব্যবহৃত জমি লিজ নিয়ে কৃষি কাজের সম্ভাবনা আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি। অর্থাৎ প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা খুবই প্রয়োজনীয় এবং তার সুযোগ রয়েছে। এ সম্পর্ক উন্নয়নে জরুরি হলো বিরোধীয় ইস্যুগুলোর নিষ্পত্তি।
ইতিমধ্যে মিয়ানমারে রাজনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। সেখানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। আমরা আশা করব, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অর্থনৈতিক সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করবে।
এখানে বলা যেতে পারে যে, দুটি দেশ 'বিমসটেক' জোটের সদস্য। সহযোগিতার আরেকটি বিষয় হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ। বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান থেকে ভারত ও মিয়ানমার প্রাকৃতিক গ্যাস পেয়েছে। নির্ধারিত সীমারেখার একটু পূর্বে রয়েছে মিয়ানমারের একটি বড় গ্যাসফিল্ড। এক সময়ে এই গ্যাস বাংলাদেশ ও ভারতকে তারা রফতানি করতে চেয়েছিল। এখন তা যাচ্ছে চীনে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। যে কারণে বিশ্বের বড় গ্যাস কোম্পানিগুলো এখানে কাজ করতে আগ্রহী। এখন বাংলাদেশ যে ইকোনমিক জোনের অধিকারী হলো সেখানে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান কাজে আর কোনো বাধা থাকল না। একটি বড় কোম্পানি ইতিমধ্যেই ওই এলাকায় দায়িত্ব পেয়েছে। আমরা আশা করব, এ অনুসন্ধান বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সর্বোচ্চ করার প্রচেষ্টা নেওয়া হবে এবং বাপেক্সকে কাজে লাগানো হবে। এ সংস্থাকে বিদেশিদের পরিবর্তে পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণের উপযোগী করার জন্যই এটা করা চাই। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, গভীর সমুদ্রে কাজ করা কারিগরিভাবে খুবই কঠিন ও জটিল। এ ছাড়া সমুদ্রের ঝড়-ঝাপটার ভয় তো আছেই। এ কাজে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের সহায়তার মাধ্যমে অনুসন্ধান কাজ হাতে নিতে হবে। আমাদের ধারণা, বাংলাদেশ সরকারের এ বিষয়ে প্রস্তুতি রয়েছে এবং যথাশিগগির সম্ভব অনুসন্ধান কাজ হাতে নেওয়া হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রকৃতি সংরক্ষণ ও মৎস্যসম্পদ আহরণ সম্পর্কিত। বঙ্গোপসাগরে প্রাকৃতিক, বিশেষ করে মৎস্যসম্পদ সম্পর্কে ধারণা এবং তথ্য-উপাত্ত পর্যাপ্ত নয়। সম্পদের ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত দুর্বল। কয়েকদিন আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা গেল, ট্রলারগুলো কীভাবে মাছ নষ্ট করে। বঙ্গোপসাগরে মাছের বিরাট আধার রয়েছে। তিমি থেকে ক্ষুদে কেচকি মাছ, সব মিলবে এখানে। বাঙালিরা সামুদ্রিক মাছের পরিবর্তে মিঠাপানির মাছ বেশি পছন্দ ও সুস্বাদু বলে মনে করে। কিন্তু সমগ্র পৃথিবীতে যেসব দেশের সমুদ্র উপকূল রয়েছে তারা সবাই সামুদ্রিক মাছই খেয়ে থাকে। পুষ্টির দিক বিবেচনায় সামুদ্রিক মাছের গুণ বোধহয় অনেক বেশি।
২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল পাওয়ার পর বাংলাদেশের কাজ হবে এটির সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, তদারক করা এবং সম্পদ আহরণকে টেকসই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। এ জন্য নৌবাহিনী ও কোস্টাল গার্ডকে অবশ্যই শক্তিশালী করতে হবে। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে ট্রলার এসে যেন আমাদের মৎস্যসম্পদ লুট করে না নিতে পারে তার ব্যবস্থা করা চাই। এ ছাড়া আমাদের সমুদ্রসীমায় জাহাজে ব্যবহৃত তেল ফেলে দূষণকারী জাহাজগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।
বর্ষায় সমুদ্র উত্তাল থাকে। কিন্তু শীতে শান্ত উপকূলীয় এলাকায় ইকো-ট্যুরিজমের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে সামুদ্রিক ডলফিন এবং ভোস করে ভেসে ওঠা তিমি অথবা হাঙ্গরের বিচরণ দেখতে বহু পর্যটক আগ্রহী হবেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, সমুদ্রের তলদেশের সম্পদের পাশাপাশি মৎস্যসম্পদের ব্যবস্থাপনা এখন নির্বিঘ্নে হাতে নেওয়া সম্ভব হবে।
এ লেখার ইতি টানব তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, যারা এই আইনি লড়াইয়ে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। আমাদের অনেকের জানা নেই যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি একজন আইনজ্ঞও বটে। জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল খোরশেদ আলম সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত ইস্যুতে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়ে দীর্ঘদিন তপস্যার মতো লেগে ছিলেন। এ দু'জনকে আমাদের বিশেষভাবে অভিনন্দন ও অভিবাদন।

স অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত :উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরিবেশ বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.