চরাচর-আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস by শরাফত হোসেন

'জাদুঘর ও স্মৃতি' এ স্লোগান সামনে রেখে এবারও ১৮ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। এ দিবসটি উদ্যাপনে মূল প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, 'স্মৃতিগুলো গল্প শোনায়'। আন্তর্জাতিকভাবে জাদুঘর দিবস পালনের ইতিহাস খুব পুরনো না হলেও জাদুঘরের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে এ দিবসটি উদ্যাপনের রীতি,

অথচ খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে মিসরের আলেকজান্দ্রায় টমেলি প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি, তিনি যার নাম রেখেছিলেন মিউজিয়াম, সেটিকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম জাদুঘর। জাদুঘর বা মিউজিয়াম শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ 'মউজিয়ন' থেকে। গ্রিকদের কলাবিদ্যার দেবী মিউজেসের মন্দিরকে একসময় মিউজিয়াম বলা হতো। টলেমি তাঁর লাইব্রেরিকে মিউজিয়াম নাম দিয়ে জ্ঞানের তীর্থস্থান বোঝাতে চেয়েছিলেন। জাদুঘরকে একদা পণ্ডিতের পাঠশালাও বলা হতো। কালে কালে জাদুঘর মূলত পুরাকীর্তি সংরক্ষণ ও গবেষণার সূতিকাগারে পরিণত হয়। পুরাতত্ত্ব একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানে অগ্রসরণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে, যার মধ্য দিয়ে সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাকে চিহ্নিত করা যায়। আলেকজান্দ্রায় টলেমির লাইব্রেরিতে বিজ্ঞান ও ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বহু পুরাকীর্তির সমাবেশ ঘটেছিল। পরে রোমান যুগে মিউজিয়াম শব্দটি ইউনিভার্সিটি হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণে পোপ চতুর্থ সিঙ্টাস (১৪৭১-১৪৮৪), পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার (১৪৯২-১৫০৩) ব্যাপক অবদান রাখেন। এরপর দ্বিতীয় জুলিয়াস (১৫০৩-১৫১৩) জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ইতিহাসকে একধাপ এগিয়ে দেন। তবে ষষ্ঠদশ শতকের আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠার চর্চা শুরু হয়নি। ষষ্ঠদশ শতকে ইংল্যান্ডে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানভিত্তিক প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণের চর্চা শুরু হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৬৮৩ সালে অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে 'দ্য আশমোলিয়াম মিউজিয়াম' প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আরো প্রায় ১০০ বছর পরের ঘটনা। ১৭৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি স্যার উইলিয়ামের উদ্যোগে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে 'এশিয়াটিক সোসাইটি' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ১৭৯৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জাদুঘর স্থাপনার কার্যক্রম শুরু হয়। ঢাকায় জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট, তখন এর নাম রাখা হয়েছিল ঢাকা জাদুঘর, যা পরে ১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর জাতীয় জাদুঘর নামে পরিচিতি পায়। তবে বাংলাদেশের প্রাচীনতম জাদুঘর হচ্ছে রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। ১৯১০ সাল থেকে বরেন্দ্র জাদুঘরের প্রত্নসম্পদ অন্বেষণ ও গবেষণাকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দয়ারামপুরের জমিদার শরৎকুমার রায়, বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্র, রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দ্র। পরে তাঁদের কাজের সঙ্গে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রামকমল সিংহ ও কলকাতা জাদুঘরের রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় যুক্ত হয়ে বিপুল পরিমাণ পুরাকীর্তি সংগ্রহ করেন। বরেন্দ্র জাদুঘরে বর্তমানে প্রায় ৯ হাজার পুরাকীর্তি রয়েছে। বাংলাদেশে এখন জাদুঘরের সংখ্যা শতাধিক। এখানে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক জাদুঘরও স্থাপিত হয়েছে। যেমন_ রেলওয়ের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ সৈয়দপুরের রেল জাদুঘর, পঞ্চগড়ের রক মিউজিয়াম, সোনারগাঁয়ের লোকশিল্প জাদুঘর, ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিষয়ভিত্তিক জাদুঘর হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে এ সব কিছুর আগে বিবেচিত হবে যে জাদুঘরটি, সেটি হলো জাতীয় জাদুঘর। জাতীয় জাদুঘরের সীমাবদ্ধতা অনেক। জাতীয় জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শন রয়েছে ৮৫ হাজার। স্থানাভাবে এসব নিদর্শনের সামান্যই গ্যালারিতে উপস্থাপিত আছে। বেশির ভাগ নিদর্শনই গুদামজাত রয়েছে। গুদামজাত নিদর্শনের মধ্যে কিছু অমূল্য নিদর্শনও রয়েছে। মাঝেমধ্যে কিছু নিদর্শন অদল-বদল করে গ্যালারিতে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। জাতীয় জাদুঘরের চারটি বিশেষ কর্নার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শরাফত হোসেন

No comments

Powered by Blogger.