উন্নয়ন-বঙ্গবল্পুব্দ ও বেহাত কৃষি বিপ্লব by এম আফজাল হোসেন

বিখ্যাত দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, 'পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও গৌরবমণ্ডিত শিল্প হচ্ছে কৃষি।' শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও দার্শনিক রুশোর বাণীকে লালন করেছিলেন। বঙ্গবল্পুব্দ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি সোনার বাংলা গড়তে কৃষি শিল্পের উন্নয়ন অপরিহার্য।

তিনি উপলব্ধি করতেন কৃষি একটি জ্ঞাননির্ভর শিল্প। গতানুগতিক কৃষি ব্যবস্থা দ্বারা দ্রুত ক্রমবর্ধমান বাঙালি জাতির খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য চাই কৃষির ব্যাপক আধুনিকীকরণ। আর কৃষি শিল্পের আধুনিকীকরণ ও লাগসই উন্নয়নের একমাত্র কারিগর হচ্ছে কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটবৃন্দ। এ জন্য বঙ্গবন্ধু '৬৯-এর গণআন্দোলনের ১১ দফায় কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদার আসন প্রতিষ্ঠিত করেন। সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আত্মমর্যাদাশীল কৃষিবিদরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে দেশের বর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠীর খাদ্য জোগানে নিয়োজিত রয়েছেন। কৃষিবিদদের চিন্তা-চেতনা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, আধুনিক প্রযুক্তিগত ধারণা ও প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ উপহার দিতে সক্ষম হবে বলে আমি আশাবাদী।
কৃষির সার্বিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু যে মমত্ববোধ ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রদত্ত ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আজও সাক্ষ্য দেয়। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি গৌরবময় দিন। বঙ্গবন্ধু শত ব্যস্ততার মাঝেও কৃষি ও কৃষকের টানে ছুটে এসেছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবুজ শ্যামল আঙিনায়। এ দেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের সঙ্গে যে তার আত্মার সম্পর্ক ছিল তা প্রদত্ত ভাষণে তিনি স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। সবুজ বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের যে অবস্থা সত্য কথা বলতে কি_ বাংলার উর্বর জমি বারবার দেশ-বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও শোষকদের টেনে এনেছে এখানে। এত উর্বর এত সোনার দেশ যদি বাংলাদেশ না হতো তবে এতকাল আমাদের পরাধীন থাকতে হতো না। যেখানে মধু থাকে সেখানে মক্ষিকা উড়ে আসে। সোনার বাংলা নাম আজকের নয়। বহুদিনের সোনার বাংলা। বাংলার মাটির মতো মাটি দুনিয়ার আর কোথাও দেখা যায় না। বাংলার মানুষের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলার সম্পদের মতো সম্পদ দুনিয়ায় পাওয়া যায় না।' তিনি কৃষির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলেন, 'যেভাবে মানুষ বাড়ছে সেভাবে যদি আমাদের কৃষির উন্নতি না হয় তা হলে ২০ বছরের মধ্যে বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সে কারণেই আমাদের কৃষির দিকে নজর দিতে হবে।' কৃষিবিদদের উদ্দেশে বলেন, 'আপনাদের কোট-প্যান্ট খুলে একটু গ্রামে নামতে হবে। কেমন করে হালচাষ করতে হয়, এ জমিতে কত ফসল হয়, এ জমিতে কেমন করে লাঙল চষে, কেমন করে বীজ ফলন করতে হয়। আগাছা কখন পরিষ্কার করতে হবে। ধানের কোন সময় নিড়ানি দিতে হয়। কোন সময় আগাছা ফেলতে হয়। এগুলো বই পড়লে হবে না। গ্রামে গিয়ে আমার চাষি ভাইদের সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল কাজ করে শিখতে হবে। তাহলে আপনারা অনেক শিখতে পারবেন। অনেক আগে কৃষি বিপ্লবের কথা বলছি। ৫০০ কোটি টাকার ডেভেলপমেন্ট বাজেট করেছিলাম এবং ১০১ কোটি টাকা কৃষি উন্নয়নের জন্য দিয়েছি। ভিক্ষা করে টাকা আমি জোগাড় করেছি।' বঙ্গবন্ধু কৃষি ও কৃষক তথা আপামর জনগণের মুক্তির জন্য আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তার প্রদত্ত ভাষণ থেকে তা সহজেই অনুমেয়। তিনি ছিলেন আবহমান বাংলার একজন পথচারী। বাংলার মাটির সাধারণ মানুষ।
এ উপমহাদেশের আর এক জাতির জনক ও অসহযোগ আন্দোলনের পথিকৃৎ মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, 'একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি এক টুকরা রুটির মধ্যে স্রষ্টাকে দেখেন।' বঙ্গবন্ধু এই ঐতিহাসিক বাণী উপলব্ধি করে বলেছিলেন, 'খাবার অভাব হলে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। সেজন্য খাওয়ার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে অন্নহীন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে। এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার জন্য বাঙালি জাতি যখন অগ্রসরমান, ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর নিজ বাসভবন ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটি স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী মহলের হস্তক্ষেপে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আর আশার আলো দেখেনি। কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার, অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদির ফলে বিগত দিনগুলোতে বিপুল সম্ভাবনাময় কৃষি খাতে উন্নয়নের কোনোরূপ ছোঁয়া লাগেনি।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন 'সোনার বাংলা' গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি উন্নয়ন, মহিলাদের কৃষিতে অংশগ্রহণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। পরবর্তীকালে কয়েকটি বছর আবার কৃষি খাতের উন্নয়ন থমকে ছিল। ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত শক্তি আবার ক্ষমতায় এলে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার আরও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। কৃষি খাতে আবার ভর্তুকি, সার বিতরণ ব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, শস্য বহুমুখীকরণসহ অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭২ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে যেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টন সেখানে ২০০৮-০৯ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ১২ লাখ মেট্রিক টন অর্থাৎ শস্যের উৎপাদন প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উৎপাদনও কয়েকগুণ বেড়েছে। কৃষিক্ষেত্রে এ যুগান্তকারী সাফল্য বঙ্গবন্ধুর অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখবে।

প্রফেসর ড. এম আফজাল হোসেন : ভাইস চ্যান্সেলর, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
 

No comments

Powered by Blogger.