বিচার বিভাগ-মেধাবীদের নিয়োগ নিশ্চিত হোক

১৪ জুলাই ২০১১ ষষ্ঠ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। এতে সহকারী জজ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নতুন শর্তারোপ করা হয়েছে। এই নতুন শর্তমতে জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রার্থীকে অবশ্যই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তির সনদধারী

হতে হবে। এই অযৌক্তিক শর্তারোপ বিচার বিভাগের নিয়োগ-প্রক্রিয়াকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাবে, যা সহকারী জজ পদে মেধাবীদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করবে। আমরা এ দেশের নাগরিক ও একই সঙ্গে আইনের ছাত্র হিসেবে এ বিষয়ে উৎকণ্ঠিত।
আইনজীবী হিসেবে আইনের চর্চা এবং একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার বিচারিক কাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির দুটি বৃত্তি। তাই সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার শর্ত হিসেবে বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তি সনদের সংযোজন পুরোপুরি অযৌক্তিক। বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তির সনদ মূলত কোনো একটি স্থানীয় বারের অধীনে আদালতে মামলা পরিচালনার একটি অনুমতিপত্র মাত্র, যাকে কোনো মানদণ্ডেই শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। অথচ এই অনুমতিপত্রকেই ষষ্ঠ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার সার্কুলারে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিরোনামের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্তির পাঠ্যসূচি, মূল্যায়ন পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার পাঠ্যসূচি ও মূল্যায়ন পদ্ধতি থেকে ভিন্নতর। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রিধারী কোনো ছাত্রের আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছা না-ও থাকতে পারে, তবে জজ হওয়ার স্বপ্ন থাকতেই পারে। কেন একজন ছাত্রকে জজ হতে হলে আগে আইনজীবী হতেই হবে? সংবিধানও কিন্তু এই শর্ত সমর্থন করে না। উচ্চ আদালতের বিচারক হতে ৯৫ অনুচ্ছেদে তাই সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে ১০ বছর কিংবা কোনো বিচার বিভাগীয় পদে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার বিধান রয়েছে। হাইকোর্টের বিচারক হওয়া শুধুই আইনজীবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকলে নিম্ন আদালতে তা থাকার যৌক্তিকতা কী? বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদমতে, সাত বছরকাল বিচার বিভাগীয় পদে বহাল না থাকলে অথবা ১০ বছর অ্যাডভোকেট না থাকলে কোনো ব্যক্তি জেলা বিচারক পদে নিয়োগলাভের যোগ্য হতেন না। এর অর্থ, জেলা বিচারক হতে ১০ বছর আইনজীবী থাকার চেয়ে সাত বছর বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার অভিজ্ঞতাটা দামি। পঞ্চম সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে ওই মূল ১১৫ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবনের সুপারিশ রয়েছে। সুতরাং, ঘোষিত সার্কুলারের শর্ত আপিল বিভাগের ওই রায়েরও চেতনাবিরুদ্ধ।
সদ্য স্নাতক ডিগ্রিধারীদের আইন সম্পর্কে প্রায়োগিক জ্ঞান না থাকার যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য? বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির দিকে তাকালে এটা শতভাগ অর্থহীন মনে হবে। সেখানে কার্যবিধি-সম্পর্কিত আইন, মুটকোর্ট, ক্লিনিক্যাল লিগ্যাল এডুকেশন প্রভৃতি ব্যবহারিক বিষয়ের ওপর প্রভূত গুরুত্বারোপ করা হয়। তা ছাড়া আদালত ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আইন ব্যবসায় অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে না। আদালত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে চাকরিকালীন অবস্থায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা যায়। সহকারী জজ পদটি নিম্ন আদালতের একটি প্রবেশ পদ মাত্র এবং প্রজাতন্ত্রের কোনো প্রবেশ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না।
বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়ায় অনিয়মের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশ আইন কমিশনের ‘রিভিউ অব লিগ্যাল এডুকেশন’ শিরোনামে ২০০৬ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে প্রতিষ্ঠানটি ক্রমেই অধিকতর রাজনৈতিক প্রভাবদুষ্ট হয়ে উঠছে (পৃষ্ঠা-৫৯)। বার নির্বাচনে পাস করার জন্য তালিকাভুক্তির মাধ্যমে ভোটার সৃষ্টির একটি প্রবণতা দেখা যায়।
ষষ্ঠ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তির ৫(ক) দফায় শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কোন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হইতে আইন বিষয়ে ন্যূনতম দ্বিতীয় শ্রেণীর স্নাতক অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীর এলএলএম ডিগ্রী।’ অর্থাৎ আইন বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে তৃতীয় শ্রেণী পেয়ে পরবর্তী সময়ে এলএলএম পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণী অর্জন করেও যে কেউ সহকারী জজ পদে নিয়োগ পেতে পারেন।
পঞ্চম জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রায় তিন হাজার ছাত্রছাত্রী অংশ নিয়ে এর প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষায় প্রায় দেড় হাজার ছাত্রছাত্রী পাস করেন, যাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই আইন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রিধারী। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রিধারী কেবল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই দুই হাজারের অধিক শিক্ষার্থী ষষ্ঠ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যোগ করা হলে বঞ্চিতদের এই সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। ওই সার্কুলারে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার শর্ত হিসেবে বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তির মূল সনদের ফটোকপি চাওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল প্রকাশ ও বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তির দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় একজন আইনের ছাত্রের তিন বছর সময় লেগে যায়। ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮-এর সনদ প্রদানের জন্য সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১১ সালে, এরই মধ্যে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন-চারটি ব্যাচ তাদের স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে বসে আছে; যারা ষষ্ঠ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না।
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিসে প্রবেশ পদে নিয়োগের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শিক্ষাগত যোগ্যতার সর্বশেষ ধাপ, অর্থাৎ স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সনদ জমা দিয়েই সার্ভিসের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া যায়। এমনকি স্নাতকোত্তর ডিগ্রিরও প্রয়োজন হয় না। এর পেছনে যে দর্শন কাজ করে তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা, ফল প্রকাশের প্রক্রিয়া ও নিয়োগ-প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রী হলে পরীক্ষার্থী যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন। কিন্তু নতুন শর্তের ফলে আইন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রিধারীরা সহসাই আবেদন করতে পারবেন না। বর্তমানে মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি বিরাট অংশ আইন বিষয়ে পড়তে আগ্রহী। কিন্তু নতুন শর্তারোপের কারণে বিচারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে।
যাঁরা পঞ্চম জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন ষষ্ঠ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন না। এই নতুন শর্তটি বাতিল করা না হলে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী সহকারী জজ পদে নিয়োগের সুযোগ হারাবেন। অন্যদিকে অযোগ্য, অপেক্ষাকৃত কম মেধাসম্পন্নদের বিচারক পদে নিয়োগের ঝুঁকি বাড়বে। ফলে মামলায় রায়ের মান নিম্নমুখী হবে, যা উচ্চ আদালতে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি করবে। সর্বোপরি জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবতাবিবর্জিত। আমরা আশা করব, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন নতুন শর্তারোপের সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করে মেধাবীদের সহকারী জজ পদে নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
লেখকেরা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থী।

No comments

Powered by Blogger.