চারদিক-‘বিদ্যার সাগর তুমি...’ by সুরঞ্জিত বৈদ্য

পাঠশালার পাঠ শেষ করে গুরুমশাইয়ের পরামর্শে ইংরেজি শিক্ষার উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি শিশু বাবার সঙ্গে হেঁটে চলেছে কলকাতায়। যেতে যেতে শিশুটি ঘটিয়ে বসল এক অবাক কাণ্ড। পথের মাইলস্টোন দেখে দেখে শিশুটি শিখে ফেলল ইংরেজি সংখ্যা গণনা।

এই শিশুটি একদিন আপন প্রতিভাবলে দেশবাসীর কাছে পরিচিতি পেল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে।
১৮২০ সালের ২৬ জুন মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম ঠাকুরদাম বন্দ্যোপাধ্যায়, মা ভাগবতীদেবী। বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার কারণে ঈশ্বরচন্দ্র পাঠশালার পড়া প্রস্তুত করতেন রাস্তায় জ্বালানো গ্যাসের বাতির নিচে দাঁড়িয়ে। এভাবেই পাঠশালার পাঠ শেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র বাবার সঙ্গে কলকাতায় এসে শিবচরণ মল্লিকের বাড়িতে ওঠেন। শিবচরণ মল্লিকের বাড়ির পাঠশালায় এক বছর পড়ার পর ১৮২৯ সালের ১ জুন ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতায় সরকারি সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যয়ন করে ব্যাকরণ, কাব্য, অলংকার, বেদান্ত, ন্যায় স্মৃতি ও জ্যোতিষশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সংস্কৃত কলেজে তিনি মোট ১৩ বছর পড়াশোনা করেন এবং ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন।
সংস্কৃত কলেজের পড়াশোনা শেষ করে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগে হেড পণ্ডিতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখানে পাঁচ বছর তিন মাস অধ্যাপনার পর ১৮৪৬ সালের ৬ এপ্রিল বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। অল্প কিছুদিন পর বিদ্যাসাগর সহকারী সম্পাদক থেকে অধ্যাপক এবং পরে অধ্যক্ষের পদে অধিষ্ঠিত হন। বিদ্যাসাগর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন এক তেজস্বী পুরুষ ছিলেন। সেই আমলে ইংরেজদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে চলার বিদ্যাসাগরের মতো জেদি পুরুষ খুব কমই ছিলেন। এ প্রসঙ্গে একটি গল্পের উল্লেখ করি: ‘একবার সংস্কৃত কলেজের বিশেষ কাজে বিদ্যাসাগর হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কারসাহেবের কাছে যান। কারসাহেব টেবিলের ওপর জুতাসহ দুই পা তুলে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কথা বলেন। কারসাহেবের এ রকম অভদ্র আচরণে বিদ্যাসাগর অসন্তুষ্ট হলেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর কারসাহেব আবার হিন্দু কলেজের কাজে সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের কাছে আসেন। এবার বিদ্যাসাগর তাঁর চটি দুটি পায়েসহ দুই পা টেবিলের ওপর রেখে কারসাহেবের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। এমনকি কারসাহেবকে বসতে বলার মতো ভদ্রতাও প্রদর্শন করেননি। কারসাহেব তো মহাক্ষ্যাপা। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে বিদ্যাসাগরের এই অপমানের কথা জানালেন। উত্তরে বিদ্যাসাগর জানালেন, ‘এই সভ্যতা আমি কারসাহেবের কাছে আগেই শিখেছি। তিনিও আমার সঙ্গে এই রকম ব্যবহার করেছিলেন।’
বিদ্যাসাগর অধ্যাপক পদে থাকার সময়ই বাংলায় উন্নতমানের পাঠপুস্তকের অভাব অনুভব করেন। এই অভাব পূরণ করার জন্যই গদ্যসাহিত্য রচনা শুরু করেন। তিনি স্বীয় প্রতিভাবলে বাংলা গদ্যের আড়ষ্টতা দূর করে তাতে একটি সাবলীলতা আনতে সক্ষম হন। এ সময় তিনি বহু বাংলা গদ্যগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর হাতে পড়েই বাংলা গদ্যরীতি তার আপন পথ খুঁজে পায়। তিনি শিল্পসম্মত বাংলা গদ্যের স্রষ্টা। এ জন্যই তাঁকে বাংলা গদ্যের ‘জনক’ বলা হয়।
চাকরি গ্রহণের পর বিদ্যাসাগর আরও একটি কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। তা হলো পুরো সংসারের দায়িত্ব। বাবা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তাঁকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। আর তাঁকে খাটতে হবে না। এরপর ছোট ভাইকে নিজের কাছে এনে পড়াশোনা করাতে লাগলেন। শুধু নিজের আত্মীয় নয়, এ সময় অনেক অনাথ ছাত্রও তাঁর বাসগৃহে থেকে লেখাপড়া করত। পরের দুঃখে সর্বদা কাতর বিদ্যাসাগরের কাছে একবার খবর এল, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্ত্রী-ছেলে-পরিবার নিয়ে সুদূর ইউরোপে দেনার দায়ে জেলে যাওয়ার অবস্থা। ধারকর্জ করে সেই আমলে ছয় হাজার টাকা সংগ্রহ করে বিদ্যাসাগর তাৎক্ষণিকভাবে মাইকেলের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। এটা নিয়ে অনেকেই রসিকতা করে বলতেন, ‘মাইকেল তোমার ঋণ শোধ করবে না।’ বিদ্যাসাগর হেসে উত্তর দিতেন, ‘মাইকেল কাব্য-সাহিত্যে জন্মভূমির বহু ঋণ পরিশোধ করেছেন, আমার ঋণ আর কতটা।’
বিদ্যাসাগরের জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি তাঁর অদম্য সমাজসংস্কারমূলক কাজ। আমাদের দেশের যুগপ্রাচীন নানা সামাজিক কুপ্রথা উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা ছিল অসম সাহসী অভিযাত্রীর মতোই। তিনি বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ উপস্থাপন করে পুস্তক প্রকাশ করলে হিন্দু রক্ষণশীল সমাজ বিধবা বিবাহের তীব্র বিরোধিতায় মারমুখী হয়ে ওঠে। বিধবা বিবাহ আইন পাস করার জন্য তিনি গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া কাউন্সিলে একটি আবেদনপত্র পেশ করেন। নানা বিরোধিতা সত্ত্বেও বহুবিধ বিচার-বিশ্লেষণের পর ব্যবস্থাপক সভা কর্তৃক বিধবা বিবাহ আইনের খসড়াটি গৃহীত হয়। তারপর ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই গভর্নর জেনারেলের সম্মতিক্রমে এটি আইনে পরিণত হয়। বিদ্যাসাগরের তত্ত্বাবধানেই ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আইন অনুসারে প্রথম বিধবা বিবাহ করেন সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। এরপর বিভিন্ন স্থানে তাঁর নেতৃত্বে বহু বিধবা বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিদ্যাসাগর ছিলেন মা-বাবার একান্ত বাধ্য সন্তান। একবার তিনি মায়ের কথা রক্ষা করতে উন্মাতাল খরস্রোতা দমোদর নদী সাঁতার কেটে পার হয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছিলেন। সেই বিদ্যাসাগরের কি না মায়ের সঙ্গে মতবিরোধ হয় বিধবা বিবাহ নিয়ে। তিনি মায়ের চেয়েও বড় করে দেখেছিলেন লাখো বিধবা মায়ের দুঃখকে। তিনি নিজের ছেলের সঙ্গে এক বিধবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে এই আইন প্রচলনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
শুধু বিধবা বিবাহ নয়, তিনি বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও দীর্ঘকাল সংগ্রাম করে গেছেন। এ ছাড়া স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারেও বিদ্যাসাগরের অবদান অনস্বীকার্য। আজীবন সংগ্রামী, সমাজসংস্কারক, মানবদরদি এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের মূল্যায়ন সত্যিই কঠিন। কবি মাইকেলের কবিতায় কিছুটা হলেও এর প্রকাশ—
‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু—উজ্জ্বল জগতে
হিমাদ্রির হেমকান্তি অম্লান কিরণে।’
১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ কর্মযোগী মানুষটি পরলোকগমন করেন। আজ ছিল বিদ্যাসাগরের ১২০তম মৃত্যুদিবস। মৃত্যুদিবসের এই দিনে তাঁর প্রতি রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সুরঞ্জিত বৈদ্য

No comments

Powered by Blogger.