সময়ের প্রতিধ্বনি-মমতাময় পশ্চিমবঙ্গ এবং কিছু স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা by মোস্তফা কামাল

সত্যিই যেন মমতাময় পশ্চিমবঙ্গ। মমতার বিপুল বিজয়ে পশ্চিম বাংলার ঘরে ঘরে আজ আনন্দের বন্যা বইছে। তার ঢেউ উপচে পড়ছে বাংলাদেশের মাটিতেও। মমতার বিজয় যেন সব বাঙালির বিজয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সাদামাটা এক নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কী কথাবার্তায়, কী চলনে-বলনে_তাঁর অতি সাধারণ রূপটিই ভেসে ওঠে।

সত্যিকার অর্থেই তিনি তৃণমূলের নেত্রী। তিনি নিজেই বলেছেন, 'হতদরিদ্র সাধারণ মানুষকে নিয়েই আমার রাজনীতি। তাঁদের কল্যাণ সাধনই আমার ব্রত।' সেই সাধারণ মানুষটি তাঁর কৃতকর্মের বদৌলতে অসাধারণ এক নেত্রী রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গই শুধু নয়, আপামর বাঙালির কাছে প্রিয় মমতাদি। অবশেষে আগামী শুক্রবার তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনাকে সুস্বাগত।
এক দশক আগেও কেউ ভাবেননি, মমতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হবেন। সেই ১৯৭৭ সালে সিপিআই (এম) নেতা জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেন। ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পাহাড়সম জনপ্রিয়তা নিয়ে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় তিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি শুধু নিজ দলে না, সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। তাঁরই হাত ধরে আসেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু তিনি কোথায় যেন খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। ২০০০ সালের পর থেকেই বাম রাজনীতির ভাগ্যাকাশে মেঘ জমতে শুরু করে। মাঝেমধ্যে মেঘের আড়ালে সূর্যের দেখা মিললেও তা স্থায়ী হয়নি। বাম জোটের একের পর এক ভুল রাজনীতি আর জনবিরোধী নীতি এক স্রোতে মিলিত হয়। ক্ষয় শুরু হয় এখান থেকেই। আর এর সুযোগ নিতে সক্ষম হন বিচক্ষণ মমতা।
পরিবর্তনের অঙ্গীকার আর মা মাটি মানুষের স্লোগান নিয়ে মমতা ছুটে গেছেন পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে। প্রতিটি সমাবেশে, পথসভায় বামদের ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মমতা। দুই লাখ কোটি রুপি ঋণের বোঝা, বেকারত্ব, শিল্পায়নের ব্যাপারে বুদ্ধদেব সরকারের ভ্রান্তনীতিই পশ্চিমবঙ্গকে পিছিয়ে রেখেছে। এতটা পশ্চাৎপদ রাজ্য ভারতে খুব কমই আছে। অনেক সুযোগ ছিল পশ্চিমবঙ্গকে এগিয়ে নেওয়ার। সেই সুযোগ কাজে লাগাননি বুদ্ধদেব। কাজের চেয়ে বক্তৃতাবাজিই বেশি করেছেন। তাঁর মুখে দম্ভোক্তিও শোনা গেছে বেশ। সেটাই বুঝি কাল হয়েছে তাঁর। বাম জোট তো হেরেছেই, তিনি নিজের আসনটিও ধরে রাখতে পারেননি। ইতিহাসের কী নির্মম শিক্ষা! নিশ্চয়ই এটা তাঁর প্রাপ্য ছিল। তা না হলে এতটা মুখ ফিরিয়ে নেবেন কেন মানুষ!
সত্যি সত্যিই পরিবর্তন চেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। সরাতে চেয়েছিল তাদের ওপর চেপে বসা জগদ্দল পাথর। তাই মমতার পরিবর্তনের ডাকটি ছিল যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। দলবেঁধে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ ছুটেছে তাঁর পেছনে পেছনে। একেবারে দুই হাত ভরে দিয়েছে মমতাকে। বামপন্থীদের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন তিনি। বলা যায়, মমতার জনপ্রিয়তার কাছে একেবারে মুখথুবড়ে পড়েছে বাম জোট। বিধানসভার ২৮৫ আসনের মধ্যে বাম জোট পেয়েছে মাত্র ৬২টি আসন। মমতার তৃণমূল পেয়েছে ১৮৪টি এবং কংগ্রেস পেয়েছে ৪২টি। গত নির্বাচনেও এ ফলাফল ছিল ঠিক উল্টো।
অনেকে বলে থাকেন, বুদ্ধদেবের রাজনৈতিক গুরু জ্যোতি বসু হলেও তাঁর কাছ থেকে সুশিক্ষাটা তিনি নিতে পারেননি। মমতা দূর থেকে জ্যোতি বসুর সব গুণই ধারণ করেছেন। আসলে মাটি আর মানুষের নেতা জ্যোতি বসুর ছায়া মমতার ওপর। জ্যোতি বসুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করবেন মমতা। তিনিই পারবেন পশ্চিমবঙ্গকে এগিয়ে নিতে। নিশ্চয়ই তিনি মানুষের ভালোবাসার প্রতিদান দেবেন। বুকভরা আশা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ। তাঁর সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিশ্চয়ই মমতা প্রস্তুত। মমতার কাছে এপার বাংলার মানুষেরও অনেক প্রত্যাশা। প্রত্যাশা এ কারণে, মমতা বাংলাদেশ এবং এ দেশের মানুষকে বড় ভালোবাসেন। এ দেশের মানুষও তাঁকে আপনজন বলে মনে করে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সব বাঙালির স্বার্থে তিনি কাজ করবেন। বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষায় দায়িত্ব পালন করবেন। প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নেও তিনি জ্যোতি বসুর মতো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন আশা করি।
প্রিয় পাঠক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলতে গিয়ে বার বার মনে পড়ছে প্রয়াত বর্ষীয়ান জননেতা জ্যোতি বসুর কথা। আপাদমস্তক তিনি ছিলেন একজন বাঙালি। তাঁকে অনেকবার খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। কখনো রাইটার্স ভবনে, কখনো ঢাকায় আবার কখনো তাঁর গ্রামের বাড়ি বারোদিতে। বাংলাদেশ এবং এ দেশের মানুষের জন্য তাঁর ছিল অগাধ ভালোবাসা। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর কারণেই ৩০ বছর মেয়াদি ঐতিহাসিক গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি সই হয়েছিল। সেই একই রকম আন্তরিকতা দেখেছি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যেও।
মমতাকে প্রথম দেখি ১৯৯৯ সালে কলকাতায়। তখনো শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কলকাতা বইমেলা উদ্বোধন করতে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন। সে বছর কলকাতা বইমেলার থিম কান্ট্রি ছিল বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে আমিও কলকাতায় গিয়েছিলাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর হোটেল স্যুটে দেখা করতে আসেন। আমরা তাঁদের আলাপচারিতার খবর সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, মমতা কয়েকজন নেতা-কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলের লবিতে ঢুকছেন। সঙ্গে ফুলের তোড়া এবং শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা একটি দীর্ঘ কবিতা। তিনি শেখ হাসিনাকে বড় বোন সম্বোধন করেন। তিনি নিজেই পড়ে শোনালেন। তাঁর সেই আবেগময় আবৃত্তি শুনে আমরাও আবেগতাড়িত হয়েছিলাম।
সেই এক যুগ আগেও মমতা বলেছিলেন, 'যখনই বাংলাদেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পাই, আমি করব। এটা কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়, বাংলাদেশের প্রতি আমার আন্তরিকতা ও ভালোবাসা থেকেই করব।'
২০০০ সালে তিনি বিজেপি জোট সরকারের রেলমন্ত্রী। সাউথ ব্লকের (পররাষ্ট্র দপ্তর) আমন্ত্রণে ভারত সফরে গিয়েছিলাম। তখন মমতার সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আমরা দিলি্লতে মমতার অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তখন তিনি ভারতের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছিলেন। আমরা তখন তাঁকে অনুরোধ করলাম, বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সহযোগিতা করুন। তিনি বললেন, 'অবশ্যই করব। আমি তো চাই, শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রেল যোগাযোগ নয়, ভারতের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন হোক। দুই দেশের মধ্যে পণ্য ও যাত্রীবাহী ট্রেন কেন চলবে না? ১৯৬২ সালের আগ পর্যন্ত তো দুই দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ সচল ছিল! আমি দেখি, আমার বোনের (শেখ হাসিনা) সঙ্গে কথা বলব।'
মমতা তাঁর কথা রেখেছিলেন। তিনি রেলমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ খাতে বিপুল সহায়তা করেছিলেন। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের চুক্তি এবং তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁর সময়ই দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী ট্রেন চালু হয়েছিল।
শুধু সরকারে থাকতেই নয়, ক্ষমতার বাইরে থেকেও তিনি বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছেন। কংগ্রেস জোটের রেলমন্ত্রী হিসেবেও মমতা বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রেখেছেন। সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে দেখা হয় গত বছরের জানুয়ারি মাসে দিলি্লতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর হোটেল স্যুটে দেখা করতে এসেছিলেন মমতা। সাক্ষাতের পর তিনি বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেন, 'বড় বোন হাসিনা আমার জন্য জামদানি শাড়ি আর ইলিশ মাছ এনেছেন। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। আমি তাঁকে বলেছি, শুধু রেল যোগাযোগ নয়, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। সেগুলো চিহ্নিত করে সহযোগিতা আরো সম্প্রসারণ করতে হবে। দুই দেশের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় ও নিবিড় করতে হবে।'
আমরা আশা করি, এভাবেই মমতা বাংলাদেশের সুহৃদ হিসেবে কাজ করবেন। তিনি ক্ষমতাসীন কংগ্রেস জোটের অন্যতম শরিক। এখন তিনি আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় সরকারেও তাঁর ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।
আমরা জানি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার ২০০ কিলোমিটারের যে সীমান্ত রয়েছে, তার বেশির ভাগই পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। বেশির ভাগ সীমান্ত এলাকা অপরাধী চক্রের অভয়ারণ্য। উভয় দেশের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা দুই দেশে অরক্ষিত সীমান্ত এলাকায় লুকিয়ে থাকে। প্রতিদিনই সীমান্তপথে অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য চোলাচালান হয়। নারী-শিশু পাচারের ঘটনাও প্রতিদিনকার। চোরাচালানি ধরার নামে অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। এসব বন্ধে নিশ্চয়ই মমতা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন। সুন্দর ও মসৃণ হোক মমতার পথচলা। সেই সঙ্গে বলব, মমতার বাংলাদেশপ্রীতি অটুট থাকুক। দুই বাংলার সম্প্রীতি ও প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক আরো নিবিড় হোক_এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.