উপদেষ্টাদের দাপটে মন্ত্রীরা অসহায় by এহসানুল হক

'প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা এখন রাজশাহীর মানুষের উন্নয়নের পথে ইচ্ছাকৃত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন।' গত ৮ মার্চ কালের কণ্ঠের কাছে এ মন্তব্য করেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ও রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন।

মেয়র লিটন আরো বলেন, 'গ্যাস সংকটের অজুহাত তুলে তিনি (উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী) এখন বলছেন, রাজশাহীর বাসাবাড়িতে দেওয়ার মতো গ্যাস নেই। কিন্তু আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, তিনি নিজের এলাকা সিলেটে ঠিকই গ্যাস দিচ্ছেন।'
একই দিন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ জাতীয় সংসদে বলেছেন, 'সংসদে মন্ত্রী নেই, উপদেষ্টা নেই, বিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যার কথা কার কাছে বলব? উপদেষ্টা তো নির্বাচিত প্রতিনিধি নন, সংসদে আসেন না। তাঁর আসার দরকারও নেই। জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নেই। আবার উপদেষ্টার কথার বাইরেও কিছু হয় না।' এর আগে ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট তোফায়েল আহমেদ নিজ নির্বাচনী এলাকার বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে জাতীয় সংসদে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, 'বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় কে চালায়, জানি না। ক্ষমতা কার, জানি না। এটি মন্ত্রী চালান, না উপদেষ্টা চালান? উপদেষ্টাকে ফোন করলে তিনি ধরেন না।'
তোফায়েল আহমেদ ও খায়রুজ্জামান লিটনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করলেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবরা। তাঁরা প্রায় একই সুরে কালের কণ্ঠকে বললেন, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর মতো প্রধানমন্ত্রীর অন্য উপদেষ্টারা তিন বছর ধরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ওপর প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে খবরদারি করছেন। নিয়োগপত্র অনুযায়ী নির্ধারিত বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক অন্যান্য দায়িত্ব পালন করার কথা উপদেষ্টাদের।
অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা দেখভালের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, লোকবল নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও চাকরিচ্যুতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি, বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগসহ হেন বিষয় নেই, যাতে উপদেষ্টারা নাক গলান না। এমনকি সরকারের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে যে 'রুলস অব বিজনেস' আছে, সেটিও আমলে নেন না কোনো কোনো উপদেষ্টা।
জানা গেছে, উপদেষ্টারা প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের লোক হওয়ায় তাঁদের নানা হস্তক্ষেপের বিষয়ে ভয়ে মুখ খোলেন না মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা। এমনকি মন্ত্রিপরিষদের সিনিয়র সদস্যরাও উপদেষ্টাদের বিষয়ে নিজেরদের নাম প্রকাশ করে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। উপদেষ্টাদের হস্তক্ষেপে যখন কোনো কাজ আটকে যায় অথবা ধীরগতি হয়ে পড়ে, তখন মন্ত্রীরা তাঁদের অসহায়ত্বের কথা ক্ষমতাসীন নেতা-কর্মীদের গোপনে জানাতে বাধ্য হন। ফলে ওই নেতারা অসহায় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদের পক্ষ হয়ে উপদেষ্টাদের নানা হস্তক্ষেপের কাহিনী জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন ফোরামে প্রকাশ্যে তুলে ধরছেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু গত ৬ মার্চ জাতীয় সংসদে বলেছেন, 'সরকার ও প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা এবং মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের বাক-চপলতা নিয়েও মানুষ হতাশ, বিরক্ত। মন্ত্রীরা এক রকম বলেন, উপদেষ্টারা বলেন আরেক রকম। এ যেন দোতলা বাস। একতলায় মন্ত্রীরা, দোতলায় উপদেষ্টারা। দোতলা বাস ধীরেই চলে। ছোট গাড়ি দ্রুত চলে। সরকারের কাজের গতি বাড়ানো দরকার।'
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, "কথা বলা সবার গণতান্ত্রিক অধিকার। আওয়ামী লীগের মতো দলে সমালোচনারও সুযোগ রয়েছে। এ কারণে নতুন এমপিরাও কথা বলতে পারছেন। আমরা 'ইয়েস ম্যান'-এ বিশ্বাসী নই। তবে সব কিছুরই একটা সীমারেখা থাকা উচিত। কার কী সীমারেখা, কথা বলার সময় সেটা তাঁকেই নির্ধারণ করতে হবে।"
এ রকম কথাবার্তায় সরকার বিব্রত হচ্ছে কি না জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী বলেন, যাঁরা কথা বলছেন তাঁরাই বলতে পারবেন এতে সরকারের ভালো হচ্ছে, না মন্দ হচ্ছে। বিভিন্ন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর কাজে উপদেষ্টাদের হস্তক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কোনো মন্তব্য করতে চাননি কৃষিমন্ত্রী।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে সাতজন উপদেষ্টা। তাঁরা হলেন এইচ টি ইমাম (জনপ্রশাসন বিষয়ক), ড. মসিউর রহমান (অর্থনৈতিক), ডা. মোদাচ্ছের আলী (স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ এবং সমাজকল্যাণ), ড. আলাউদ্দিন আহমেদ (শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনীতি), ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী (বিদ্যুৎ ও জ্বালানী), ড. গওহর রিজভী (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক (প্রতিরক্ষা)। প্রথম ছয়জন মন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন ও সর্বশেষ জন প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার।
সূত্র জানায়, ৪৬ সদস্যের মন্ত্রিসভার সঙ্গে যোগ হয়েছেন এই সাত উপদেষ্টা। মন্ত্রিসভার সব বৈঠকে যোগ দেন উপদেষ্টারা। এতে সরকারের ব্যয়ও বেড়ে গেছে অনেক বেশি। এক হিসাবে জানা গেছে, বেতন-ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বাবদ গত তিন বছরে সাত উপদেষ্টার পেছনে সরকারের ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ৪৫ লাখ ৭৮ হাজার ২০০ টাকা। অথচ বিগত চারদলীয় জোট সরকারের ৬০ সদস্যের মন্ত্রিসভার ব্যয় নিয়ে প্রায়শই কঠোর ভাষায় সমালোচনা করতে দেখা গেছে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে ঘিরে পেশাদার কূটনীতিকদের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ও ড. গওহর রিজভীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে বিভিন্ন ইস্যুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যখন ছিল দৃশ্যত নীরব, তখন গণমাধ্যমে রীতিমতো সরব ছিলেন ওই দুই উপদেষ্টা। সফরের আগে ভারতের কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ছাড়া অন্য যেসব শীর্ষ কর্মকর্তা ঢাকা সফরে এসেছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠকের আগে আলাদাভাবে বৈঠক করেন ওই দুই উপদেষ্টার সঙ্গে। এমনকি তখন এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েসকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, 'পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আসলে কে চালান?' পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালান বলে মিজারুল কায়েস উত্তর দিলেও পেশাদার কূটনীতিকদের বাইরে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের দিলি্লতে যাওয়া-আসা বিভিন্ন সময় বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। অনলাইনভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম উইকিলিকসের ফাঁস করা নথিতেও দেখা গেছে, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের আগেই উপদেষ্টা গওহর রিজভী ঢাকায় তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে সম্ভাব্য চুক্তিগুলো সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। অথচ বিষয়টি রাষ্ট্রের অত্যন্ত গোপন বিষয়। ফাঁস হওয়া নথিতে আরো দেখা গেছে, ওই উপদেষ্টা বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দূরদর্শিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এ ছাড়া ওই সময় অভিযোগ উঠেছিল, ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আগে থেকে তেমন কিছুই জানতেন না। এমনকি ২০১০ সালের শেষের দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা তথা 'রুলস অব বিজনেস' ও 'রুলস অব এলোকেশন' প্রায়শই মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ তোলা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত যেকোনো ইস্যুর ব্যাপারে রুলস অব বিজনেস যথাযথভাবে অনুসরণ করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগসহ প্রধানমন্ত্রীর সব উপদেষ্টা, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে লিখিতভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। রুলস অব বিজনেসের সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করে ওই চিঠিতে বলা হয়, পররাষ্ট্র সম্পর্ককে প্রভাবিত করে- এমন সব বিষয় নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করা বাধ্যতামূলক। কোনো কোনো সময় বিষয়টির ব্যত্যয় ঘটানো হচ্ছে বলে চিঠেতে উল্লেখ করা হয়।
গত ৪ মার্চ ক্ষমতাসীন জোটের অন্যতম শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ও গওহর রিজভীকে ইঙ্গিত করে জাতীয় সংসদে বলেন, 'ট্রানজিট, শুল্ককাঠামো ও টিপাইমুখ বাঁধসহ দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা যেভাবে কথা বলেন তাতে মনে হয়, তাঁরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা নন, তাঁরা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, ভারত সরকারের উপদেষ্টা।' এই দুই উপদেষ্টাকে ইঙ্গিত করে গত ৫ মার্চ ফেনী নদী অভিমুখে লংমার্চের বিভিন্ন পথসভায় মহাজোট সরকারের আরেক শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, এ সরকার দুর্বল, দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে ভারতের সঙ্গে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারে না। আর সরকারের উপদেষ্টারা ভারতের হয়ে কথা বলেন।
দুটি মন্ত্রণালয় ও একটি বিভাগের সচিব অভিযোগ করেন, উপদেষ্টাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যেই সরকারকে বেশ কয়েকবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। যেসব ঘটনা মহাজোটের নেতারা প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন, সেগুলোই শুধু সাধারণ মানুষ জানতে পারেন। কিন্তু উপদেষ্টাদের অযাচিত হস্তক্ষেপে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীরা একের পর এক কোণঠাসা হচ্ছেন- এমন অসংখ্য ঘটনা ধামাচাপা পড়ছে। এমনকি উপদেষ্টাদের কথা পুরোপুরি অনুসরণ না করায় বেশ কয়েকজন সচিবকে বদলি হতে হয়েছে- এমন ঘটনাও রয়েছে।
উপদেষ্টাদের অযাচিত হস্তক্ষেপের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন না কেন- জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেব? তাঁরা অরাজনৈতিক ও অনির্বাচিত ব্যক্তি হয়েও সাংঘাতিক প্রভাবশালী। বিধি অনুযায়ী তাঁদের তো সরকারি কোনো নথিতেই স্বাক্ষর করার কথা না। কিন্তু সবই তো চলছে। তাঁদের ওপর রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি আশীর্বাদ। তাই কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন হতে চান না।'
ওই সদস্য আরো বলেন, বর্তমান সরকারের প্রথম বছরে এক উপদেষ্টার পরামর্শে দুই বিচারককে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত এবং পরে তা প্রত্যাহারের ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে। ওই ঘটনায় প্রকাশ্য বিরোধে জাড়িয়ে পড়েছিলেন উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সভাপতি ও বর্তমান রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ওই কমিটির বৈঠক শেষে সংসদ ভবনে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দুই বিচারককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং আইন ও সংস্থাপন (বর্তমানে জনপ্রশাসন) সচিবের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে তাঁদের তলবের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আরো জানিয়েছিলেন, ওই বিষয়ে আইনমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রী কিছু জানতেন না। কমিটি দেখতে পেয়েছে, এ-সংক্রান্ত নথিতে তাঁদের স্বাক্ষর ছিল না।
পরে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ স্বাক্ষরের বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছিলেন, 'সারসংক্ষেপটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয়নি। এইচ টি ইমাম ও সংস্থাপন (বর্তমানে জনপ্রশাসন) সচিবের স্বাক্ষর করা সারসংক্ষেপ আইনসচিবের কাছে নির্দেশ আকারে পাঠানো হয়। তখন আমি স্বাক্ষর করি। অর্থাৎ এটা আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রস্তাব ছিল না। এ প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এ সম্পর্কিত বক্তব্যটি সঠিক।'
পরে এইচ টি ইমাম এ ঘটনার ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, 'দুই বিচারককে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমার একার নয়। এটা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের।' যাঁরা বলছেন, এ ঘটনায় আইনমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী সম্পৃক্ত ছিলেন না, তাঁরা ঠিক বলেননি। অবসর দেওয়ার সারসংক্ষেপে আইনমন্ত্রী স্বাক্ষর করেছেন। আইনসচিব বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন।'
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতি, বদলিসহ প্রশাসনের নানা কার্যক্রমে উপদেষ্টার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ সব সময়ই আছে। এসব হস্তক্ষেপে সব সময় ইতিবাচক সাড়া দেননি বলে সংস্থাপন (বর্তমানে জনপ্রশাসন) সচিবের পদ থেকে মো. ইকবাল মাহমুদকে সরে যেতে হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন আমলা। এ ছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপদেষ্টার দ্বন্দ্ব গত দুই বছর ধরে চলছে। ২০১০ সালে এক হাজার ১৬১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির চূড়ান্ত তালিকা উপদেষ্টার মাধ্যমে প্রণীত হওয়ার পর থেকেই মন্ত্রী-উপদেষ্টার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর পর থেকেই প্রায় সব কাজই চলছে উপদেষ্টার ইশারায়। মন্ত্রী-উপদেষ্টার দ্বন্দ্বও 'ওপেন সিক্রেট'। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীন সব দপ্তরে সরজমিন ঘুরে জানা গেছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে গতকাল বৃহস্পতিবার ল্যান্ডফোনে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'নো কমেন্টস। আমার অবস্থান থেকে এ ব্যাপারে কোনো কিছু বলা ঠিক হবে না।'
এমপিওভুক্তিতে হস্তক্ষেপ এবং শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শীতল সম্পর্ক বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, 'কিছুদিন আগে আমার স্ট্রোক হয়েছিল। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হইনি। তাই বেশি কথা বলা ঠিক হচ্ছে না।'
এদিকে চিকিৎসক ও নার্সদের নিয়োগ-বদলিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চলছে একরকম অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার একদিকে আছেন মন্ত্রী ও সরকার সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), অন্যদিকে উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। এমন টানাটানির মধ্যে চলছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রায় সব কাজের অগ্রগতি ঝিমিয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা।
প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ এবং সমাজকল্যাণ বিষয়ক উপদেষ্টা ডা. মোদাচ্ছের আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের কাজের ওপর উপদেষ্টাদের হস্তক্ষেপের বিষয়টি আমার জানা নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক উপদেষ্টারা যাবতীয় কাজ করে থাকেন।' উপদেষ্টাদের অযাচিত হস্তক্ষেপের বিষয়টি মহাজোটের নেতারা জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন ফোরামে প্রকাশ্যে বলছেন- এ প্রসঙ্গ তুললে তিনি বলেন, 'পত্রপত্রিকায় দেখেছি। জাতীয় সংসদের কোনো বিষয়ে বলার এখতিয়ার আমার নেই। কারণ উপদেষ্টারা সংসদ সদস্য নন। আর সংসদের বাইরে যাঁরা বলেছেন, তা ১৪ দলের বিষয়। এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না। কোনো কিছু বলার থাকলে ১৪ দলীয় জোট থেকে বলবে।' কোন প্রেক্ষাপটে নেতারা এসব কথা বলেছেন, তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নিয়োগ, বদলিসহ অন্যান্য বিষয়ে ডা. মোদাচ্ছের আলীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য, ভিত্তিহীন দাবি করে তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্যমন্ত্রী অথবা সমাজকল্যাণমন্ত্রী বলতে পারবেন না, আমি কোনোদিন তাঁদের কাজে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেছি।'
ড. মসিউর রহমান ও ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী দেশের বাইরে থাকায় তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আর বক্তব্য নেওয়ার জন্য এইচ টি ইমাম ও ড. গওহর রিজভীর সেলফোনে গতকাল বৃহস্পতিবার একাধিকবার চেষ্টা করা হয়। রিং হলেও তাঁরা কেই ফোন ধরেননি।

No comments

Powered by Blogger.