ঐতিহাসিক রায়-বাংলাদেশের ন্যায্যতার সমুদ্রসীমা

বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ অংশে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হওয়ায় দেশবাসীর মতো আমরাও আনন্দিত ও উদ্বেলিত। মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়াও কম স্বস্তির নয়। আমাদের মনে আছে, বিরোধপূর্ণ এলাকায় যুদ্ধজাহাজ প্রহরায় মিয়ানমারের তেল-গ্যাস জরিপ ২০০৮ সালের নভেম্বরে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি

করেছিল। এখন সহাবস্থানের নীতিতে অভিন্ন সমুদ্রাঞ্চলের অমিত সম্ভাবনা দুই দেশই কাজে লাগাতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সার্বভৌমত্ব, সমরনীতি ও সম্পদের সদ্ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায় নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। এই বিজয় আমাদের জন্য প্রত্যাশিতও বটে। ইটলস'-এর (ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন ল অব সি) রায়ের মধ্য দিয়ে আরেকটি ঐতিহাসিক সত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো যে, বাংলাদেশের পাদদেশের বিস্তীর্ণ জলরাশির নাম বঙ্গোপসাগর_ বাংলাদেশের উপসাগর। বে অব বেঙ্গল_ বার্মিজ বা ভারতীয় উপসাগর নয়। কেবল নামকরণের ঐতিহাসিক ভিত্তি নয়; স্বাধীনতা-পরবর্তী ৩৮ বছর ধরে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আমরা যে ন্যায্যতাভিত্তিক সমুদ্রসীমার কথা বলে এসেছি, বহুপক্ষীয় ট্রাইব্যুনালের রায়ের মধ্য দিয়ে তা-ও সঠিক প্রমাণিত হলো। আমরা আশা করি, এই রায়ের আলোকে ভারতের সঙ্গেও সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হবে। মিয়ানমারের মতো ভারতও ইকুইডিসটেন্স পদ্ধতিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের কথা বলে আসছে। ভারতের সঙ্গে বিরোধের বিষয়টি যদিও নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত অন্য একটি আদালতে নিষ্পত্তি হবে, জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত ট্রাইব্যুনালের রায় এর জন্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ নজির। আমরা বিশ্বাস করি, হামবুর্গে ঝলকানো ন্যায্যতার আলো হেগেও প্রতিফলিত হবে। মিয়ানমার-বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জন্যও বিবেচ্য হবে। আমরা আশা করি, বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমাংশেও একইভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হবে। এটাও এখন উল্লেখ্য, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় ব্যয় করে বিলম্বে হলেও আমাদের সরকার আন্তর্জাতিক সালিশির দ্বারস্থ হয়েছিল। সাহসী ও দূরদর্শী সেই সিদ্ধান্তের জন্য এই বিজয়ের পর সরকারকে সাধুবাদ জানানো সব পক্ষের কর্তব্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে এর অতিরিক্ত সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলমের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলকে আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি। দুই বছরের বেশি সময় ধরে তারা যে শ্রম ও মেধা ব্যয় করেছেন, তা দেশের গুরুত্বপূর্ণ কাজে লেগেছে। বাংলাদেশের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সওয়াল-জওয়াব করা বিদেশি আইনজীবীদেরও অভিনন্দন। একই সঙ্গে মিয়ানমারের প্রতিও আমাদের শুভেচ্ছা। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে সহযোগিতার মাধ্যমে তারা সৎ প্রতিবেশীসুলভ নীতির পরিচয় দিয়েছে। আমরা আশা করি, বৃহত্তম বিরোধটি নিষ্পত্তির পর রেঙ্গুন-ঢাকার অন্যান্য দূরত্বও কমে আসবে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সুসম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকেই এখন বেশি উদ্যোগী হতে হবে। উদ্যোগী হতে হবে নিষ্পন্ন সমুদ্রসীমার সর্বোত্তম ব্যবহারের প্রতিও। আমাদের জলসীমার মৎস্যসম্পদ অন্য দেশের জেলেরা আহরণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিরোধপূর্ণ এলাকার কারণে এতদিন সেখানে পূর্ণ নজরদারি রাখা সম্ভব হয়নি। সে সংকট কেটে যাওয়ার পর বঙ্গোপসাগরের মৎস্যসম্পদ বাংলাদেশের সমৃদ্ধিতে কাজে লাগানো কঠিন হবে না। আমাদের সমুদ্রসীমায় দেশি-বিদেশি জলদস্যু নিয়ন্ত্রণও এখন সহজ হবে বলে আমরা মনে করি। ওই অংশের সমুদ্রবক্ষের তেল-গ্যাস উত্তোলনের দিকে এখন মনোযোগ দিতে হবে। সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির মতো সে ক্ষেত্রেও জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে হবে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আনা বাংলার স্বাধীনতা ও স্বার্থের প্রশ্নে নূ্যনতম ছাড়ও আমরা দিতে পারি না।

No comments

Powered by Blogger.