কবিতার পাঠক কম নয়, বাছাই করা-ছন্দে মিলে গন্ধে আনন্দে কবিতা by আল মাহমুদ

কবিতা কারও মুখাপেক্ষী নয়। কবিতা সব সময় কবির অন্তরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি স্পন্দিত করে কাব্য-পাঠকদের হূদয়ে গুঞ্জরিত হয়। সে বেঁচে থাকে শব্দে, গন্ধে, মিলে ও মাত্রায়। কবিতা যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের সংখ্যা সব সময় সর্বকালে অতিশয় নগণ্য ছিল; কিন্তু কিছু লোকের মধ্যেই তাঁদের হূদয়ে কাব্যের স্পন্দন ঘড়ির শব্দের মতো টিকটিক করে বাজতে থাকে।

কবিরাই সাধারণত একেকটি ভাষায় স্রষ্টা ও কারিগরের মর্যাদা পান। কেউ কেউ কবিকে কারিগর না বলে জাদুকর বলে সম্বোধন করেন। আধুনিক কবিতা যে চরিত্র বর্তমানে তরঙ্গ তুলেছে, সেটা খানিকটা গতিপ্রবণ, যাকে বলে লিরিক্যাল। কবিরা ছন্দে-মিলে-গন্ধে-আনন্দে লিরিক তৈরি করতেই বেশি আগ্রহী। এ যুগের কবিরা মিলকেই মহত্তর অভিব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ফলে গদ্যশক্তি থেকে আমাদের দেশে কাব্যশক্তি প্রাধান্য পেয়েছে বেশি, অথচ আধুনিকতার প্রশ্ন উঠলে আমাদের সমকালীন গদ্যের কাছে যেতে হবে। কারণ, গদ্যই হলো আধুনিকতার বার্তাবহ। কবিতা ও গদ্যের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকলেও আমাদের দেশে নানা কারণে গদ্যের চেয়ে পদ্যের সুখ্যাতি তরঙ্গায়িত হয়েছে, এটা একটা অসাধারণ ঘটনা হলেও এটা কেবল বাংলাদেশেই এবং বাংলা ভাষাতেই সম্ভব হয়েছে, যেহেতু একালের কয়েকজন প্রধান কবি একসঙ্গে কালের মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এ জন্য কাব্যশক্তির প্রাধান্য অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে আধুনিকতায় বাহন ও বার্তাবহ হলো গদ্য। অদ্যাবধি কবিতার জয়জয়কার শোনা গেলেও আধুনিকতার প্রশ্ন উঠলে আমাদের অবশ্যই গদ্যের কাছে যেতে হবে। আর আমাদের গদ্যের তরঙ্গ অসাধারণ সঞ্চরণশীল। কাঁপছে-ফাঁপছে এবং ভাবছে। এই ভাবনার তরঙ্গ সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে ছন্দে-মিলে ও মধুরতায়। এসব গুণ যদিও কাব্যে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ঘটেছে অন্য রকম পরিস্থিতি। এখানে কাব্যের স্ফূর্তি ঘটলেও গদ্য পিছিয়ে নেই। অনেক অসাধারণ গদ্যলেখক গল্পে-উপন্যাসে নিজেদের কীর্তি স্থাপন করেছেন। উত্থাপিত হয়েছে আধুনিকতা এবং বাংলা ভাষায় এক মর্মস্পর্শী জ্বালা-যন্ত্রণার কাহিনি, যার অন্তর্বস্তু আধুনিক, সমাধুনিক এবং সমকালীন তথা স্বচ্ছ।
আমাদের দেশে কবিতা স্ফূর্তি পেয়েছে বেশি, এর কারণ আমি আগেই বলেছি, দেশের প্রধান কয়েকজন কবি একই সঙ্গে একই কালে বাংলা ভাষায় সমকালীন মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন। ফলে অন্যান্য দেশের ভাষার ক্ষেত্রে যা ঘটে না, বাংলা ভাষায় সেটা সম্ভবপর হয়েছিল।
সন্দেহ নেই, বাংলা ভাষা এ যুগে বিশ্ব ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে এক উদাহরণস্থল হয়ে উঠেছে, এটা হতে পেরেছে বহু কবি-সাহিত্যিক ও নাট্যলেখকের একাগ্র চিন্তা ও আন্দোলনের ফলে। আমরা আমাদের ভাষাকে নিয়ে অতীতে বহু আন্দোলন করেছি, যা অন্যান্য দেশের ভাষার ইতিহাসে ঘটেনি, তা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ঘটে গিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও আদায় করেছে।
কবিতা সব সময়ই কম মানুষকে আগ্রহান্বিত করে তোলে। আমাদের ক্ষেত্রে যদিও কাব্যের এই নিয়ম লক্ষ্যযোগ্য হয়নি, তবু কয়েকজন অসাধারণ কবির ঐকান্তিক চেষ্টায় এখানে, বিশেষ করে বাংলাদেশে কাব্যই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। অথচ আধুনিকতার বিচারে গদ্যেরই প্রাধান্য পাওয়ার কথা ছিল। যদিও বাংলা গদ্য পিছিয়ে আছে, এ কথা বলা যাবে না। অনেক তরুণ লেখকের গদ্যচর্চা, বিশেষ করে ছোটগল্প ও ক্ষুদ্র উপন্যাস, আধুনিকতায় এবং মর্মবস্তুতে প্রেমের সংস্পর্শ থাকায় তা অতিশয় মজবুত কাঠামো পেয়েছে।
আমাদের তরুণ গদ্যলেখকেরা বেশ কিছু সম্ভাবনাময় সাহিত্যের সাধনা করে যাচ্ছেন, তাঁদের লেখার বিষয়ও অতিশয় হূদয়স্পর্শী। ভালোবাসার কাহিনি রচনায় আমাদের কিছু কবি ও গল্পলেখক অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে একটি যুগের সৃষ্টি করে গেছেন, তাঁদের রচনা এখনো ঠিকমতো আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। তবে অবশ্যই এক দিন এর বিচার এবং বিবর্তনের ইতিহাস রচিত হবে।
আমাদের দেশে গদ্য-পদ্য যা কিছু নির্মিত হয়েছে, রচিত ও প্রচারিত হয়েছে, সবকিছুর একটা মাত্রাজ্ঞান খুঁজে পাওয়া যাবে। কবির কাজ শুধু কাব্যেই হবে, এটা কোনো শর্ত নয়। বহু কবি আছেন, যাঁদের প্রধান কাজ কিংবা সৃষ্টিকর্ম গদ্যে সাধিত হয়েছে।
আমি আমাদের দেশে কবিদের আক্ষেপ করতে শুনি, তাঁদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি। আমি অবশ্য এ কথার সত্যতা স্বীকার করলেও এ কথা মানি না যে আমাদের কবিরা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। আমি বরং মনে করি, বাংলা ভাষার কবিদের আমাদের দেশে সব সময় একটা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ছিল, আছে এবং থাকবে। তবে সব ভাষাতেই একটা স্থবিরতা এবং বন্ধ্যত্বের কাল ঘুরেফিরে আসে, আমাদের ভাষায়ও হয়তো বা সেটা আবর্তিত হতে চলেছে। তবে ভাষা নদীর স্রোতের মতো থামে না, ঘামে না এবং বিশ্রাম নেয় না। সে অবিরাম কালের বহমানতার সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। কোথাও স্বচ্ছ স্রোত, কোথাও ঘোলা জলে আবর্ত আছে বটে, কিন্তু নদীর গতি কে থামাতে পারে? ভাষার গতিও আমাদের ভাবনার অতীত। বিচিত্র পথে তার স্রোত বয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার শব্দ এসে ভাষার স্রোতকে সমৃদ্ধ করছে। কলকাকলি তুলছে। কোলাহলে আত্মহারা হয়ে ছুটছে সামনের দিকে। মূলত ভাষা হলো শব্দেরই তরঙ্গের নাম। শত শব্দ শতাব্দীব্যাপী ভাষার শরীরে আছড়ে পড়ছে, যুক্ত হচ্ছে, লিপ্ত হচ্ছে এবং দীপ্ত হচ্ছে। অফুরন্ত এই তরঙ্গ, অবিশ্রাম তার খেলা। শেষ নেই, সমাপ্তি নেই।
কবিতার পাঠক চিরকালই অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘু, কোনো কালেই কাব্যকে দল বেঁধে কেউ অধ্যয়ন করেনি। কবিতা সংরক্ষিত সুউচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কত কবি এসেছেন, পরিশ্রমের পরাক্রম প্রকাশ করে ছন্দে-মিলে-মাত্রায় সবাইকে অভিভূত করে দিয়ে নিঃশব্দে চলে গেছেন।
আধুনিক যুগে কবিতার সম্ভাবনা নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের জন্য একটাই কথা, সেটা হলো, মানুষ সুখে হাসে, দুঃখে কাঁদে—এটা যেমন সত্য, তেমনি মানুষের আরও একটি হূদয়বৃত্তি, যার নাম অকারণ পুলক। মানুষ দেখা যায় কোনো কোনো সময় অকারণেই উল্লাসে শিহরিত হয়। নাচে-নাচায় এবং ভাষাকে বাঁচায়। তবে প্রতিটি ভাষার জন্য কবির একান্ত প্রয়োজন। যাঁরা বলেন, এ দেশে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি, তাঁরা সত্য বলেন না। কবির সংখ্যা অতিশয় কম। শত শত কাকের চেঁচামেচির মধ্যে ঘরের বধূ মূর্ছা গেলেও দেখা যায়, সে রাত্রিকালে অভিসারে বের হয়। এটা অসতী বলে নয়, অনিবার্য বলে।

No comments

Powered by Blogger.