ইতিহাস-স্বপ্ন, সাহসে ও মুক্তিতে তিনি by আতিউর রহমান

পনেরো আগস্ট বাঙালির সবচেয়ে দুঃখের দিন। পঁচাত্তরের এই দিনেই ঘাতকদের আঘাতে প্রাণ দেন বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ জাতীয় বীর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রফিক আজাদ ঠিকই বলেছেন_ নিজের জীবন ছাড়া বাংলাদেশের সবকিছুই তাঁর কাছে ছিল মূল্যবান। 'স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে' আজ পড়ে আছে তাঁর 'বিশাল শরীর'।

এই দিঘল পুরুষ 'হাত বাড়ালেই/ধরে ফেলতো পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল/সাড়ে সাত কোটি হৃদয়/ধরে ফেলতো বৈশাখী মেঘ কেমন অনায়াসে' (বাবলু জোয়ারদার, 'সে ছিল দিঘল পুরুষ')। মনে হয় আজও তিনি বাংলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের মতো। আমাদের মতো করে আমাদের একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টির যে স্বপ্ন ঘুরে বেড়িয়েছে হাজার বছর ধরে এ ভূখণ্ডের মানুষের মনে, পথে-প্রান্তরে, তা এসে যেন থিতু হয়েছিল তাঁর অন্তরের গহিনে। ইতিহাসের এই বরপুত্রের "চোখে ধরা পড়েছিল রূপসী বাংলার সি্নগ্ধ মুখশ্রী,/তাই তাঁর চোখে ধরা পড়েছিল_ 'আমার সোনার বাংলা',/তাই তাঁর চোখে ধরা পড়েছিল মুক্তি-স্বপ্ন প্রিয়/স্বাধীনতা" (নির্মলেন্দু গুণ, 'পুনশ্চ মুজিবকথা')। আর সে কারণেই বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অবিচ্ছেদ্য এক সত্তা।
১৭ মার্চ তাঁর জন্মদিন। একাত্তরের উত্তাল মার্চের ওই দিনেও তিনি বলতে ভুলে যাননি যে, এ দেশের জনগণ এবং তাঁর জীবন অবিচ্ছেদ্য। তাদের দুঃখ তাঁরও দুঃখ। এ দেশের প্রতিটি বাড়িই তাঁর বাড়ি। ১৯৭১-এ তাঁর ৫২তম জন্মদিনে বিদেশি সাংবাদিকদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, 'আমি জীবনে কখনও আমার জন্মদিন পালন করিনি। আপনারা আমার দেশের মানুষের অবস্থা জানেন, তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। যখন কেউ ভাবতেও পারে না মরার কথা তখনও তারা মরে।... আমার আবার জন্মদিন কী, মৃত্যুদিবসই-বা কী? আমার জীবনই-বা কী? মৃত্যুদিন আর জন্মদিন অতি গৌণভাবে এখানে অতিবাহিত হয়। আমার জনগণই আমার জীবন।'
জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির চিন্তাই ছিল তাঁর একমাত্র আরাধ্য। ধীরে ধীরে তাই বাঙালির সব চাওয়া-পাওয়ার এক মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। একই সঙ্গে আবার বিশ্বের সব মানবিক উদ্বেগ তাঁর ভেতর ঠাঁই করে নিয়েছিল। সেই অর্থে তিনি ছিলেন স্বভূমিতে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এক আধুনিক মানুষ। ৩০ মে ১৯৭৩-এর ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন_
ÔAs a man, what concerns mankind concerns me. As a Bangalee, I am deeply involved in all that concerns Bangalees. This abiding involvement is born of and nourished by love, enduring love, which gives meaning to my politics and to my very being ('৩০ মে, ১৯৭৩ নিজ হাতে ইংরেজিতে লেখা বঙ্গবন্ধুর ডায়েরির একটি পাতা', শাহরিয়ার ইকবাল সম্পাদিত 'বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ বছরের দৈনন্দিন কর্মতালিকা ও কতিপয় দলিল', উত্তরবঙ্গ প্রকাশনী, ২০০০, পৃ. ১০৫)।
তাঁর মহাপ্রয়াণ তিথিতে তাই এমনই এক সম্পূর্ণ বাঙালির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে চাই তাঁর নান্দনিক তথা শিল্প ও সংস্কৃতি-ভাবনার খানিকটা উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। প্রচলিত অর্থে তিনি শিল্পী ছিলেন না। কিন্তু 'রাজনীতির এক অমর কবি' বলে তাঁকে চিহ্নিত করতে ভুল করেননি সমকালীন বিশ্বমানের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। মানুষের ভেতরে আবেগের যে উদ্বৃত্ত দেখা দেয় তা নানাভাবে প্রকাশিত হয়। সেই প্রকাশ যদি নান্দনিক হয়, তা যদি অন্যের অন্তরে সমান তালে দোলা দিতে পারে, তাকে নিশ্চিতভাবেই শৈল্পিক বলা চলে। ব্যক্তিত্বের এই সুন্দরতম প্রকাশকেও তাই আর্ট বা শিল্পের আওতায় ফেলতে পারি।
ব্যক্তিত্বের প্রকাশই আর্টের প্রধান লক্ষ্য। যে মাধ্যম ব্যবহার করে তা প্রকাশ করা হয় (ছবি, গান, বক্তৃতা ইত্যাদি) তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সত্য। সত্য ব্যক্তিত্বেরই অন্যতম দ্যুতি।
'আমার বোধ হয় আর্ট মাত্রেরই কাজ হচ্ছে বিশ্বের যেটুকু আমাদের মনোহরণ করে সেইটুকুকে সযত্নে তার অন্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমাদের কাছে অবিমিশ্র উজ্জ্বল করে ধরা। সত্যের উপরিভাগ থেকে সেইটুকু ছেঁকে নেওয়া সাজিয়ে তোলা আর্টিস্টের কাজ' (রবীন্দ্রনাথ, 'ছিন্নপত্রাবলী', ১৩১ নং পত্র। দ্র. সত্যেন্দ্রনাথ রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৫)। এই যদি হয় আর্ট বা নন্দনতত্ত্বের মূল কথা, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা চলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক বড়মাপের শিল্পী : 'রাজনীতির এক অমর কবি।' তাঁর সময়ের প্রধান কথক। প্রভাবশালী নিয়ামক। জীবন্ত এক কিংবদন্তি। তাঁর নান্দনিক ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর দৃঢ় তর্জনী হেলনে, অঙ্গভঙ্গিতে, কথায়, ব্যবহারে, আচার-অনুষ্ঠানে এবং সর্বোপরি কালজয়ী সব বক্তৃতায়, বিশেষ করে জাতির দিকনির্দেশ '৭১-এর ৭ মার্চের হৃদয়স্পর্শী ভাষণে। বাঙালির ক্ষোভ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, অপমান, জেদ, অহং, সংযম, স্বপ্ন, প্রতিরোধ, সংকল্প_ সবকিছুই সমন্বিতভাবে অর্কেস্ট্রার মতো সেদিন বেজে উঠেছিল তাঁর বজ্রকণ্ঠে। '৭১-এর ৭ মার্চের সেই অতুলনীয় ভাষণে এই সৃজনশীলতাকে তিনি কতটা দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন তা নতুন করে আজ আর বলার প্রয়োজন নেই।
আমাদের বড়ই সৌভাগ্য যে, আমাদের চাওয়া-পাওয়ার এক অনন্য প্রতীক হিসেবে একজনকে আমরা পেয়েছিলাম। কয়েক দশক ধরে তাঁকে ঘিরেই আমাদের দুঃখ ও আনন্দ আবর্তিত হয়েছে। আমাদের সব কথা সব ব্যথা যেন তাঁর হয়ে যায়। তাঁরও অন্তরের সাহসী উচ্চারণ আমাদের সবার উচ্চারণ হয়ে যায়। তিনি তাই সহজেই হয়ে যান আমাদের 'পথের দাবি'র মূল নায়ক। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন মহানায়ক। এক পর্যায়ে তিনি ও আমরা এক হয়ে যাই। তিনি আমাদের শুধু একটি জাতিই উপহার দেননি, তৈরি করে দিয়ে গেছেন একটি স্বপ্নের ঠিকানাও। কিন্তু আমরা এমনই এক হতভাগ্য জাতি যে, সেই স্বপ্নের নির্মাতাকে 'আমাদের'ই একাংশ অপমান করেছে। কেড়ে নিয়েছে তাঁর প্রাণ। সে কারণেই জাতি হিসেবে আমাদের আজ এমন নিম্নগামী যাত্রা, এমন অধঃপতন।
যে কোনো সফল রাষ্ট্রের লক্ষণই হচ্ছে যে, তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সে কিছুতেই বিতর্কিত হতে দেয় না। বিশেষ করে আগামী দিনের নাগরিকদের কাছে ইতিহাসকে কখনও ছক্কা-পাঞ্জার বিষয় করা হয় না। একটি দেশ আগামী দিনে কতটা উন্নত হবে তা কিন্তু নির্ধারিত হয়ে যায় তার বিদ্যায়তনগুলোর শ্রেণীকক্ষে। সেই শ্রেণীকক্ষে গুণমানের শিক্ষার পাশাপাশি যদি দেশের সত্যিকার ইতিহাসকে ঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয় তাহলে সমাজের ভেতরে যে আত্মশক্তির জন্ম নেয় তা খুবই অদম্য হয়ে ওঠে। সেই আত্মশক্তিই গড়ে তোলে ঘরে-বাইরের সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধ। সেই আত্মশক্তিই হতে পারে আমাদের স্বদেশী উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। আমাদের অপরিসীম দুর্ভাগ্য যে, আমাদের সন্তানদের আমরা একদিকে যেমন গুণমানের শিক্ষা দিচ্ছি না, অন্যদিকে তেমনি সত্যিকার ইতিহাসও তাদের জানাচ্ছি না।
শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় বিভিন্ন প্রজন্মের কাছে পরিচিত ছিলেন মুজিবুর, মুজিব ভাই, শেখ সাহেব ও বঙ্গবন্ধু নামে। এই সম্বোধনগুলোর মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমুজিবের বেড়ে ওঠা, পরিণতি লাভ করা ও জনসম্পৃক্ততার রেখাচিত্র ফুটে ওঠে। শেখ মুজিব তাঁর রাজনীতি শুরু করেছিলেন মুসলিম বাংলায়। সেই সময় তাঁর রাজনৈতিক দল ছিল 'মুসলিম লীগ'। আটচলি্লশ ও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ব্যক্তিমুজিবকে ও জাতিকে কতখানি নাড়া দিয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় 'মুসলিম লীগ'-এর নাম পরিবর্তন হয়ে 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' নামকরণের মধ্য দিয়ে। আরও এক ধাপ এগিয়ে 'আওয়ামী মুসলিম লীগে'র নাম হয় 'আওয়ামী লীগ'। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরুটা ছিল আটচলি্লশে। চুয়ান্নর পথ পেরিয়ে তা বাষট্টিতে পরিণত হয় শিক্ষার লড়াইয়ে। ছেষট্টিতে এ দাবি আরও স্পষ্ট হয় ৬ দফার মাধ্যমে। ৬ দফার পথ বেয়েই ঊনসত্তরে অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার দাবি মিলেমিশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হয়। এসব আন্দোলনের প্রতিটি পর্বে তিনি ছিলেন সক্রিয়। ছিলেন অন্যতম প্রধান নিয়ামক। একষট্টিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতবিরোধী তৎকালীন সরকারের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে লড়াইও ছিল সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার লড়াই। শেষ অবধি তা শুধু বাঙালি এলিটদের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের অংশ না থেকে সাধারণ মানুষের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের লড়াইয়ের অংশ হয়ে ওঠে। ঊনসত্তরের সামরিক শাসনবিরোধী গণঅভ্যুত্থান সত্তরের নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্থিতিশীল পটভূমি তৈরি করেছিল। আর এই নির্বাচনের মাধ্যমে ৬ দফাভিত্তিক পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অধিকার জনরায়ে সমর্থিত হয় এবং তার পথ ধরেই আসে একাত্তর।
সব অর্থেই একাত্তর ছিল এক হিরণ্মময় সময়। জাতি হিসেবে দানা বাঁধার এক শ্রেষ্ঠ সময়। একাত্তরের মার্চেই জন্ম নেয় বাংলাদেশ। অসহযোগের পুরোটা সময় ধরেই চলেছিল তার জন্মের উন্মাদনা। মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রস্তুতিপর্বে বাঙালির শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনের সব প্রতিনিধিই তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ান এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তোলেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকসহ সব শক্তিই আনুগত্য প্রকাশ করে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি। সে সময় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে এসে জড়ো হয়েছিলেন সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধিরা। এরপর এলো মুক্তিযুদ্ধ। দুঃখের দিনে এক হওয়ার সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সেই দিনগুলোতেও মুক্তির গান গেয়ে গেয়ে লড়াই করেছেন সংস্কৃতিসেবীরা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বিপুলভাবে উৎসাহিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তাঁর বজ্রকণ্ঠও প্রতিদিন উজ্জীবিত করত তাঁদের। তাঁর দেওয়া 'জয় বাংলা' রণহুঙ্কার তখন ছিল মুক্তি-উন্মত্ত সব বাঙালির মুখে মুখে।
বন্দিশালায় থেকেও 'তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে, তিনিই সৃষ্টি করে চলেছিলেন একটা স্বাধীন রাষ্ট্র।' এ কথা ঠিক, তিনিও সমালোচনার ঊধর্ে্ব নন। তাই বলে কতিপয় বামনের আকাশছোঁয়া এই ব্যক্তিত্বের ওপর আঘাতের যে কসরত আমরা লক্ষ্য করেছি তা ছিল একেবারেই বিসদৃশ। যে যাই বলুক না কেন, 'তিনি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাংলাদেশের মহাস্থপতি'।

ড. আতিউর রহমান :গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক
 

No comments

Powered by Blogger.