দাহকালের কথা-পরানগঞ্জ by মাহমুদুজ্জামান বাবু

১৯৮০ সালের আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় মো. জয়নাল আবেদিনের বাবা বুকের ব্যথায় কাতর হয়ে পড়লে অন্য ভাইদের নিয়ে জয়নাল বেরিয়ে পড়েছিলেন চিকিৎসক খুঁজতে। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে, বাংলাদেশের কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে ভালো চিকিৎসক ও হাসপাতাল পাওয়া ছিল অসম্ভব একটি বিষয়।

উদ্বেলিত জয়নাল ও তাঁর ভাইয়েরা মিলে বাবাকে সেই রাতেই নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরের এক বাজারে, মোহছেন বেপারীর ওষুধের দোকানে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহছেন বেপারীর বাবা জসীমউদ্দিন ছিলেন রাজাকার, আর জয়নালের বাবা ছিলেন দরিদ্র কৃষক। একদিন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জয়নালদের বাড়িতে আশ্রয় নিলে জয়নালের বাবা তাঁদের কয়েক দিন খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সে সময় তো তা-ই কর্তব্য ছিল সবার। তো, বৃষ্টি-জলকাদা মাড়িয়ে জয়নাল ও তাঁর ভাইয়েরা গিয়ে পৌঁছালেন বাজারের মোহছেন বেপারীর ওষুধের দোকানে। তাঁদের দেখে প্রতিশোধস্পৃহায় লকলকে হয়ে উঠেছিল মোহছেন বেপারীর জিব। সে বলেছিল, কেন তারা রাজাকারের দোকানে ওষুধ নিতে এসেছে? রাজাকার হয়ে সে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া কারও কাছে ওষুধ বেচবে না। বাবাকে নিয়ে জয়নালেরা বাড়ি ফেরার পর সেই রাতেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন বুকের ব্যথায় কাতর মানুষটি।
এরপরের কাহিনি বলা ও লেখার বাইরে। শোকস্তব্ধ জয়নাল নিয়তিকে চপেটাঘাত করে চলে এলেন ঢাকায় বউ-বাচ্চাসহ। শুরু করলেন রিকশা চালানো। এই ইট-পাথর-কংক্রিটের শহরের পথে পথে জয়নালের রিকশার চাকা ঘুরতে থাকল দিন-সাল-বছর গড়িয়ে। বিন্দু বিন্দু করে গড়ে ওঠা সঞ্চয় পাঠিয়ে জয়নাল তাঁর গ্রামে গড়ে তুললেন একটি হাসপাতাল; যেখানে ছয়টি শয্যা, একজন সার্বক্ষণিক পল্লিচিকিৎসক ও সপ্তাহে এক দিন সরকারি চিকিৎসকের চিকিৎসাসেবা চলমান। গড়ে তুলেছেন একটি বিদ্যালয় তৃতীয় শ্রেণীর পাঠক্রম পর্যন্ত; চালাচ্ছেন একটি মক্তবও। অক্ষরজ্ঞানহীন জয়নালের বাড়ি ময়মনসিংহের সদর উপজেলার পরানগঞ্জ ইউনিয়নের টানাহাসদিয়া গ্রামে। জয়নালের পরানের মতোই তাঁর ঠিকানা—পরানগঞ্জ!
এদিকে, আমাদের পরানগঞ্জে কত কাণ্ডই না ঘটে চলেছে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে দুই বড় রাজনৈতিক দলের তামাশা চলছেই। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা সমাজ গড়ে উঠবে বা গড়ে তুলতে হবে—এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধনিক-বণিক গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাকারী এ দুটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল দেশকে একটু একটু করে প্রতিদিন সর্বনাশের অতলে তলিয়ে দিচ্ছে। নিজেদের দলের অভ্যন্তরে কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তায় এদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মী পর্যন্ত আচরণের ক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট। তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বাতিল, রাষ্ট্রধর্ম কিংবা বিসমিল্লাহ—এর কোনটি থাকবে আর কোনটি থাকবে না, সে প্রসঙ্গে এদের কেউই জনগণের মতামতের তোয়াক্কা করেনি। দেশের মানুষ স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এরশাদের করা রাষ্ট্রধর্ম চায়নি কখনো। আবার কখনো সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্ছেদও চায়নি। এমনকি আজ যে ধর্মপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ‘ধর্ম গেল গেল’ বলে সোচ্চার, তারাও নিজ উদ্যোগে সংবিধানে বিসমিল্লাহ মুদ্রণের কাজ করেনি। ওটা আরেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের করা। ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে বুর্জোয়া শাসকেরা এসব ধর্মের আতর গায়ে মেখে সাধারণ মানুষের হাত ধরেছে, দু-একবার হয়তো কোলাকুলিও করেছে। কিন্তু দেশের সচেতন ও প্রগতিশীল মানুষ বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়ে এসবের বিরোধিতা করেছে; এখনো করছে। এটা কি দেশপ্রেম নয়?
না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা মনে করেন না। মনে করলে তিনি প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে বলতে পারতেন না যে তাঁরচেয়ে বেশি কেউ দেশের কথা ভাবে না। কখনো কোনো দেশপ্রেমিকের মুখ থেকে অন্যকে অসম্মান করে বলা এমন কথা আমরা কে-ই বা শুনেছি, শুনব? বিরোধীদলীয় নেতারও হাতে অনেক শক্তি; ক্ষমতায় যাওয়ার পর এখনকার এই সংবিধান ছুড়ে ফেলার হুংকার দিয়ে রাখছেন এখনই। সংবিধানটা যেন খেলার সামগ্রী। ওখানে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত নেই, ধর্ষিতার হাহাকার নেই, বধ্যভূমি নেই, বন্দীশিবির নেই, গেরিলা যুদ্ধ নেই...যেন সংবিধান শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার কোলাহলের বিষয়। আমাদের পরানগঞ্জে এখন এসব সার্কাস দল সার্কাস দেখাচ্ছে। যার দলে যত দক্ষ খেলোয়াড়—সেই তাঁবুর নিচে তত ভিড়, তত বেশি হাততালি, তত বেশি কৃত্রিম আলোর রোশনাই।
তাঁবুর বাইরে অন্ধকার পরানগঞ্জ। অন্ধকার মানে শ্বাপদের জ্বলজ্বলে চোখ। অন্ধকার মানে নিরুপায় মানুষের ঘুম। অন্ধকার মানে শিক্ষকের কাছে ধর্ষিতা হয়ে ক্রন্দসীর বাড়ি ফেরা। অন্ধকার মানে শবে বরাতের রাতে হিংস্রতার বলি ছয়জন তরুণ। অন্ধকার মানে খুনিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা। অথচ কথা ছিল, অন্ধকার এলে ব্যক্তিগত বৃত্ত ভেঙে আমরা বেরিয়ে পড়ব। সমস্বরে বলে উঠব, আলো চাই আলো। অন্ধকার থেকে মুক্তি চাই। পতন থেকে উত্থানের দিকে ঘুরে দাঁড়াতে চাই। সমবেত না-হোক, অন্তত একা হলেও কেউ দাঁড়াই না কেন? সেই যে জয়নালের মতো। পরানগঞ্জের জয়নাল...।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.