বহে কাল নিরবধি-অ্যাবোটাবাদে এক-পাঁচ ও আস্থার সংকট by এম আবদুল হাফিজ

মাত্র কয়েক দিন আগে অ্যাবোটাবাদে ওয়ান-ইলেভেনের মূল পরিকল্পক ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তান-মার্কিন মৈত্রী ও সহযোগিতার পরিচিত দৃশ্যপটে ওবামা প্রশাসন যে ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি করেছে, তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা আদৌ যদি সম্ভব হয়, সেই প্রক্রিয়াটিকেও নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। বিশেষ

করে পাকিস্তানের জন্য নানা কারণে এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা কঠিন হবে। পাকিস্তানের প্রতি অসন্তুষ্ট আন্তর্জাতিক সমাজেরও লাদেন ইস্যুতে নানা প্রশ্ন, নানা অভিযোগ। এর মধ্যে সবচেয়ে কম অমার্জনীয় সম্ভবত পাকিস্তানের অযোগ্যতা; যদিও বা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে অনেক অবদানে দেশটিকে প্রতারণার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায়। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ যাদের অধিকাংশই বরং মার্কিনিদের নানা ছলনা, বিশেষ করে চালকবিহীন বিমান হামলায় দেশের উপজাতীয় অঞ্চলে নারী ও শিশুসহ বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যার কারণে ইতিমধ্যেই মার্কিনবিরোধী। তাদের কাছে পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে সামরিক হেলিকপ্টারবাহিত কমান্ডো দলের মিশন সম্পন্ন_তা যে কারণেই হোক গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের কাছে এই মার্কিন আচরণ সরাসরি পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন।
অনেক সময় সাধারণ বিষয় বা ঘটনার ব্যাখ্যাও কঠিন প্রতীয়মান হয়। যেমনটি সবারই ধারণা ছিল যে ওসামা সম্ভবত কোনো পার্বত্য গুহায় তাঁর আস্তানা গেড়েছেন_সে ধারণা ব্যতিক্রম ঘটিয়ে তিনি একটি সামরিক-অধ্যুষিত গ্যারিসন শহরে বাস করছিলেন। এ-ও রীতিমতো একটি ধাঁধা যে কোনো গোয়েন্দা সংস্থা বা পুলিশের কোনো ক্লুই ছিল না এ সম্পর্কে। তদুপরি ধৃষ্টতাপূর্ণ একটি মার্কিন সামরিক পদক্ষেপ যার জন্য অপর একটি দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা সত্ত্বেও তারা সামান্য দুঃখ প্রকাশও করেনি, কিছু মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কি পাকিস্তানের মিত্র না কোনো প্রতিপক্ষ? মার্কিনিরা যদি ওসামার আস্তানার খবর জানতই, তাহলে আগের মতো পাকিস্তানের সঙ্গে সেই খবর শেয়ার করেনি কেন? মার্কিনিরা যখন পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমান্ত লঙ্ঘন করল_সেটাও বা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে অজ্ঞাত থাকল কী করে? অন্য একটি দেশ যদি এত সহজে দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হয়, তাহলে পাকিস্তানেরই বা কী ধরনের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি রয়েছে? এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে, সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক অস্ত্রভাণ্ডারও নিরাপদ নয়? ইত্যবসরে পাকিস্তানি সরকারের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিতর্কও ওপরে উঠে এসেছে। এরই মধ্যে 'ওয়াশিংটন পোস্টে' প্রেসিডেন্ট জারদারির একটি নিবন্ধ বেরিয়েছে, যার সারমর্ম হলো এই যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এ চোরাগোপ্তা আক্রমণকে অনুমোদন করেন। এক দিন পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে, যাতে ওই মন্ত্রণালয় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে 'সার্বভৌমত্ব' প্রশ্নটিও তুলে এনেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে শক্ত ভাষায় পাকিস্তানের প্রত্যাখ্যাত করার দৃঢ়সংকল্পকে আবারও পরীক্ষা না করে দেখার জন্য সতর্ক করে দিয়েছে।
পাকিস্তান সরকারের মধ্যেই এই বৈপরীত্য বিশ্বের কাছে স্পষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো এই যে পরস্পরবিরোধী দুই অবস্থানের মধ্যে কোনটি ঠিক? এখানে একমাত্র এই সিদ্ধান্তে পেঁৗছা সম্ভব যে সরকার এ মুহূর্তে একেবারেই বিশৃঙ্খল। এর চেয়েও খারাপ যে সরকারের এহেন বিশৃঙ্খল অবস্থা ও বিচ্যুতি ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন পাশ্চাত্যের শক্তিরা এবং তাদের মিডিয়া পাকিস্তানের আল-কায়েদাবিরোধী যুদ্ধে দেশটির আন্তরিকতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। পাকিস্তানি মিডিয়াও যথাযথ সময়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরার সুযোগ ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হারিয়েছে। যদিও পাকিস্তানের অনুকূলে বলার অনেক কিছুই ছিল। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান তার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে খুব একটা উদ্যোগও নেয়নি। পাকিস্তানের যদি গোয়েন্দা নজরদারি ব্যর্থও হয়ে থাকে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তো তাদের বিপুল সহায়ক সম্পদ, প্রযুক্তিগত অগ্রসরতা এবং উঁচুমানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবল থাকা সত্ত্বেও নাইন-ইলেভেনের পরিকল্পনা ধরতে পারেনি এবং সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নও ঠেকাতে পারেনি। এ কথা তো পাকিস্তানের আইএসআইসহ অন্য যেকোনো গোয়েন্দা সংস্থার বেলায়ও প্রযোজ্য হতে পারে। এ কথা সত্য যে আইএসআই অ্যাবোটাবাদে ওসামার ব্যবহৃত আস্তানা শনাক্ত করতে পারেনি এবং নিঃসন্দেহে তা একটি ব্যর্থতা। কিন্তু পাকিস্তানের সরকারের কেউ চাইলে একটি আন্তর্জাতিক শ্রোতৃমণ্ডলীকে অবহিত করতে পারত যে ২০০১ সাল থেকে পাকিস্তান আল-কায়েদার যতসংখ্যক শীর্ষ নেতাকে আটক করেছে, পাশ্চাত্যের সব গোয়েন্দা সংস্থা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা করতে পারেনি। সব মহল থেকে পাকিস্তানের সর্বশেষ গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্য নিন্দাবাদ সত্ত্বেও এটি পুনরাবৃত্তি করার মতো পরিসংখ্যান যে আফগানিস্তানে মার্কিন সন্ত্রাসবিরোধী হামলা শুরুর পর থেকে পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করার সময় ২৪৮ জন আরবকে (সম্ভবত আল-কায়েদা সদস্য) আটক করে তাদের পর্যায়ক্রমে মার্কিনিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এটাই ছিল আল-কায়েদা ধরতে পারার সবচেয়ে বড় সাফল্য। এটাই আল-কায়েদা দমনে পাকিস্তানি অবদানের শেষ নয়। গত এক যুগে খালেদ শেখ মোহাম্মদ, আবু ফারাজ আল লিবি, আবু জুবাইদা, রামদ্ধি বিন আল শিভ, উমর পাটেক (ইন্দোনেশিয়া), আম্মার আল বালুচি এবং আহমদ খালকানের মতো গুরুত্বপূর্ণ আল-কায়েদা নেতা পাকিস্তানেই আটক হয়।
এত কিছুর পরও পাশ্চাত্যের মিডিয়া এটাই প্রমাণ করতে চেষ্টা করছে যে দেশটি সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে 'ডাবল গেইম'-এ লিপ্ত রয়েছে। পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে শুরু থেকে পাকিস্তানের অবদান তো কেউ তুলে ধরেইনি, বরং তার ঘাড়ে নতুন করে চাপিয়ে দিয়েছে আস্থার সংকট। পাকিস্তানকে আজ কদাচিৎ কেউ বিশ্বাস করে বা তার বক্তব্য শুনতে চায়। পাকিস্তানের সনাতনী প্রতিপক্ষরা ইতিমধ্যে মহাসুদিনে এবং সালমান রুশদির মতো লোকেরা আটঘাট বাঁধছে পাকিস্তানকে দুর্বৃত্ত দেশের (Rongue state)-এর পর্যায়ে ফেলতে। দেশের অভ্যন্তরেও পাকিস্তানের বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব কম নয়। লোকে এমনও বলাবলি করছে যদি মার্কিনিরা এত সহজে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কমান্ডো হামলা চালাতে পারে, তাহলে ইন্ডিয়ানদেরও বা আমরা কিভাবে প্রতিহত করব? এমন প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট জবাব নেই। এ কথা ঠিক যে যুক্তরাষ্ট্র অতিসহজে পাকিস্তানে প্রবেশ করতে পেরেছিল এবং দেশটির নজরদারিতে মোতায়েন রাডার-ব্যবস্থাকেও ফাঁকি দিতে পেরেছিল। এরও টেকনিক্যাল এবং সামরিক কারণ আছে। মার্কিন নেভিসিলসের হেলিকপ্টার একে তো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসজ্জিত ছিল, তা ছাড়া পার্বত্যভূমি বিন্যাস রাডারের কার্যকারিতা অনেকাংশে হ্রাস করে দেয়। এসব বিদ্যমান সামরিক হুমকির বিচারে এসব যান্ত্রিক নজরদারির ব্যবস্থাও তাদের অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। পাকিস্তানের জন্য আফগানিস্তানের দিক থেকে হুমকির আশঙ্কা বরাবরই পূর্ব সীমান্তের চেয়ে কম। যখন ভারতীয় সীমান্ত বা পাকিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক অস্ত্রভাণ্ডারের প্রশ্ন ওঠে_পাকিস্তানের পুরো দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে যায়। এই দুইয়ের সংরক্ষণই তখন সব অগ্রাধিকার পায়। পশ্চিম সীমান্তে যেখানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সহযোদ্ধা এবং অন্যতম মিত্র আমেরিকার উপস্থিতি, সেদিক থেকে কোনো অনুপ্রবেশকারীর ভীতি পাকিস্তানের বিন্দুমাত্র ছিল না। বিন লাদেনের হত্যা-পরবর্তী দৃশ্যপটে পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্ক এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রে আস্থার সংকট ছাড়া আর কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই। তবে উভয় পক্ষকেই অর্থাৎ পাকিস্তান এবং আমেরিকাকে নিজেদের গরজেই এ সংকট থেকে উত্তীর্ণ হতে হবে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শেষ হয়েছে ভাবলে পাশ্চাত্য মারাত্মক ভুল করবে। ব্যক্তি ওসামার মৃত্যু হলেও তাঁর বিশ্বব্যাপী মিথ রয়ে গেছে। এত সহজে তাঁর বিলুপ্তি ঘটবে না।
এক যুগ ধরে চলমান সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে অঘটন-সঘটনের ইয়ত্তা ছিল না। এক-পাঁচ-এ বিশ্বাসে কিছু ফাটল সৃষ্টিতে পুরো দৃশ্যপটে এমন কোনো ছাপ পড়েনি, যা পাকিস্তানের অনুকূলে বা প্রতিকূলে যেতে পারে। একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত দেশের জন্য আমেরিকার উদার অনুদানের এখনো প্রয়োজন। তবে কিছু কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে পারে অযোগ্য বেসামরিক সরকারের কারণে। এক-পাঁচপরবর্তী দৃশ্যপট স্বাভাবিকতায় ফিরে আসতে সক্ষম, তবে তা সময়সাপেক্ষ।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.