তাঁরা শিক্ষক, তাঁরা শিক্ষার্থী! by মিল্টন বিশ্বাস

দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো কোনো শিক্ষকের মানসিকতার সংকীর্ণতা এবং ছাত্রদের ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরের সহিংস আচরণের কিছু দৃশ্যপট এই লেখায় তুলে ধরে প্রতিকারের প্রত্যাশা রইল। বাস্তব ঘটনাগুলোর নাম-ঠিকানা কাল্পনিক।

অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা চিন্তায় অগ্রগামী; এবং দেশ ও জাতির কল্যাণভাবনায় উদীপ্ত। তাঁদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে হীন মানসিকতার শিক্ষকদের স্বরূপ উন্মোচন জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের গণ্ডির মধ্যে নিজের জীবন আটকে রেখে শিক্ষকতাকে কেবল চাকরি হিসেবে গ্রহণ করে কিছুসংখ্যক শিক্ষক ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার মধ্যে নিজেকে ধন্য করে তুলেছেন। তাঁদের ক্ষুদ্র চিন্তার জগৎ শিক্ষার্থীদের কিভাবে স্পর্শ করে, সেই বিষয়েও আলোকপাত জরুরি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ ও ১৬ মে কিছু ছাত্র নামধারী শিক্ষক-বাসে হামলা চালিয়ে, শাটল ট্রেন বন্ধ করে একাডেমিক পরিবেশ বিঘি্নত করেছে এবং হুমকি দিয়েছে লাগাতার ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার। অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাদের উচ্ছৃঙ্খল ও সহিংস আচরণের পেছনে কিছুসংখ্যক শিক্ষকের ইন্ধন রয়েছে। কারণ গত বছর ৩০ নভেম্বর উপাচার্য ড. আবু ইউসুফ ইন্তেকাল করলে আজ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে কাউকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. মো. আলাউদ্দিনকে বিব্রত এবং তাঁকে ব্যর্থ হিসেবে চিহ্নিত করে উপাচার্য হওয়ার পথ পরিষ্কার করার জন্য ছাত্রদের অপতৎপরতার সঙ্গে কিছু সংখ্যক শিক্ষকের প্ররোচনার বিষয়টি জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ বছর বয়সী অবিবাহিত অধ্যাপক কমল তাঁর কাজের বুয়াকে জিজ্ঞেস করেন, রহিমের বাসায় ছাত্রীরা যায় কি না? বুয়া সেই কথা রহিমকে জানায়; এবং সে আরো জানায়, কমল তাকে পা টিপে দেওয়ার কথা বলে_এই ইঙ্গিত সে ভালোই বোঝে। সহযোগী অধ্যাপক ডালিম কুমার জাকির নামের শিক্ষককে ডালিয়া নামের ছাত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করেছেন কি না জিজ্ঞেস করা হলে জাকির অবাক হন। ডালিম কুমার জানান, ডালিয়া তার বয়ফ্রেন্ড আরিফকে নিয়ে কঙ্বাজারের কোনো হোটেলে রাতযাপন করে এসেছে। জাকির মনে করেন, এটা সেই ছাত্রীর ব্যক্তিগত বিষয়। এটা নিয়ে কথা বলা তাঁর রুচিতে বাধে। নোংরা মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় কোনো কোনো সিনিয়র অধ্যাপকদের কাছ থেকেও। একই বিভাগের জুনিয়র শিক্ষক প্রিমিয়ার নামক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম শিক্ষকতার জন্য একজন সিনিয়র শিক্ষকের শরণাপন্ন হলে তিনি বলেন, 'আপনাকে সেখানে সুযোগ দিলে তো ছাত্রীদের সঙ্গে লীলাখেলায় মেতে উঠবেন।' স্বল্প বেতনপ্রাপ্ত ওই জুনিয়র শিক্ষককে চট্টগ্রামে বাসা ভাড়া করে নিজের জীবন নির্বাহ এবং মা-বাবার ব্যয়ভার বহন করতে হয়। জীবিকার জন্য তাঁর পার্টটাইম চাকরির প্রয়োজনকে এভাবে দেখার কী অর্থ আছে? যে জামায়াতপন্থী অধ্যাপক অন্য এক প্রভাষককে লম্পট বলেছেন, দেখা গেছে, কিছু দিন আগে সেই অধ্যাপকেরই নামে নোংরা লিফলেট বেরিয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অন্যান্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তৃতীয় এবং চারটি দ্বিতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত ব্যক্তি শিক্ষক হওয়ার পর নিজেদের স্বার্থে দলীয় পরিচয় ভুলে এক হয়ে গেছেন। লিপ্ত হয়েছেন মেধাবী শিক্ষকদের চরিত্র হননে। এ তো গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক শিক্ষকের সংকীর্ণ চিন্তার কথা। এর বাইরে কলেজ ও স্কুলের চিত্র একই রকম। ঢাকার একাধিক স্কুলের শিক্ষকদের সম্পর্কে অভিযোগ হলো, তাঁর ব্যাচে প্রাইভেট পড়লে শিক্ষার্থী ক্লাসরুমে ভালো আচরণ পাবে। অন্যথায় একই শ্রেণীতে একাধিকবার থাকতে হতে পারে। গত মাসে দেশের কয়েকটি টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়েছে, খুলনার এক ছাত্রীকে বেত্রাঘাত করে মারাত্মক আহত করেছেন এক শিক্ষক। অভিযোগ আছে, ওই ছাত্রী সেই শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে যায়নি, তার সামর্থ্যও নেই। তাই এর খেসারত তাকে দিতে হয়েছে। দরিদ্র ছাত্রীটির পক্ষে কথা বলবে কে? কিছু দিন আগে সরকারি কলেজের ইংরেজির এক শিক্ষক আমাকে বলেছেন, 'আপনাদের বেতন না তুললে তো বাসা ভাড়া দিতে পারেন না। আর আমি গত আট মাসে নিজের বেতন তুলিনি।' এটা তাঁর প্রাইভেট পড়ানোর কৃতিত্ব। তিনি শহরে ৬৫ লাখ টাকায় ফ্ল্যাটও কিনেছেন। কোনো কোনো শিক্ষকের হীন মন-মানসিকতা ও আচরণের বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক দিনের পর দিন ক্লাস না নিয়ে পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হলে এক সপ্তাহে ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ করেন, তাঁকে ছাত্ররা আড়ালে তিরস্কার করে। হীন মানসিকতার প্রভাবে চিন্তা-ভাবনায় যেমন সংকীর্ণতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা শিকড় গেড়ে বসেছে, তেমনি কথায় কথায় সহিংস হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা। উল্লেখ্য, ছাত্রদের আচরণে কেবল শিক্ষক নন, অন্যান্য বিষয়ও প্রভাবক হিসেবে কার্যকর। বংশগত পরিচয়, রাজনৈতিক কদাচার এবং বিনোদনের অভাবে বিকৃতির দ্রুত প্রসার ঘটছে। আরো আছে মাদক সেবন, লেখাপড়ার চেয়ে দ্রুত ধনী হওয়ার প্রবণতা, টেন্ডারবাজি এবং রাজনৈতিক সমর্থক হিসেবে দাপট ফলানোর মতো ঘটনা। আছে গ্রুপ হিসেবে এক দিক থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত হলে সেই পক্ষে কাজ করার প্রবণতা; অপর পক্ষকে দমানোর চেষ্টা। নেতৃত্বের ব্যর্থতাও আছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না থাকায় নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না। চেইন অব কমান্ড নেই ছাত্ররাজনীতিতে। কেউ কারো কথা শোনে না। এই সুযোগে জামায়াত-শিবির ধর্মের নামে রাজনীতির মাঠ তপ্ত করে তুলছে। ২৯ ও ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র সংগঠনের দুই গ্রুপের লড়াই নিজেদের কী উপকার করেছে, এ ব্যাপারে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে একজন ছাত্রের রগ কাটার ঘটনা ছাত্রশিবিরের সম্পৃক্ততাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দুঃখজনকভাবে এ ঘটনায় জাহাঙ্গীর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অফিসারকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। ছাত্রদের সহিংস আচরণের দৃষ্টান্ত হিসেবে গত ১২ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বহনকারী বাসের সিগন্যাল অমান্য করা এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময় ঢাবির প্রক্টর বলেছিলেন, পুলিশ ঘটনাটি দ্রুত তাঁকে জানালে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। (কালের কণ্ঠ, ১৩ এপ্রিল)। ছাত্ররা তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে ভাঙচুরের ঘটনা হরহামেশাই ঘটাচ্ছে। পুলিশ এসব আকস্মিক ঘটনায় এক অর্থে দিশেহারা। শিক্ষক হিসেবে আমরা বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দিয়ে সব নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করা কোনো সভ্য আচরণের পরিচায়ক নয়।
শিক্ষক এবং ছাত্রদের নোংরা ও সহিংস আচরণের প্রতিকার অন্বেষণে প্রথমেই মনোযোগ দেওয়া দরকার সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তি এবং সমাজের আন্তসম্পর্ক আচরণবাদের মূল বিষয়। খারাপ আচরণ এই সম্পর্ককে বিনষ্ট করে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির দূরত্ব সৃষ্টি করে। ব্যক্তির আচরণ নির্ভরশীল তার মনস্তত্ত্বের ওপর। পশুর চেয়ে মানুষের বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বতন্ত্র। শারীরিক গঠন, সামাজিক সংযোগ এবং ইতিহাসের শিক্ষা মানুষকে পরিশীলিত করতে পারে। এক পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে অন্য পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ব্যক্তির আচরণ ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ জন্য স্বতঃস্ফূর্ত বুদ্ধিবৃত্তিক আচরণই কাম্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রগতিশীল চিন্তা এবং সূক্ষ্ম অনুভূতি ভালো আচরণের পূর্বশর্ত। আদর্শ মানবসমাজে মানুষ তা-ই করে, যা তার প্রয়োজন। পরনিন্দা ও পরচর্চা পরিহার করে এবং আত্মস্বার্থের ঊধর্ে্ব উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার মধ্যে ছাত্র-শিক্ষকের বর্তমান সংকট মোচন সম্ভব বলে মনে করি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
dr.miltonbis@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.