ধর্ম-রোজার ঐতিহাসিক পটভূমি by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

রোজা রাখার নিয়ম সব যুগেই প্রচলিত ছিল। রোজা নামাজের মতো একটি পুরোনো প্রতিষ্ঠান এবং পূর্ববর্তী বিভিন্ন ধর্মে রোজা পালনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আদি মানব সর্বপ্রথম নবী হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত নবী-রাসুলগণ সবাই রোজা পালন করেছেন।

রোজা শুধু নবী করিম (সা.)-এর প্রতি ফরজ করা হয়নি, পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের প্রতিও ফরজ করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘ওহে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যেন তোমরা খোদাভীতি অর্জন করতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৩)
হজরত নূহ (আ.)-কে ‘দ্বিতীয় আদম’ বলা হয়। তাঁর যুগেও সিয়াম পালন করা হয়েছিল। হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত নূহ (আ.) পর্যন্ত চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ ‘আইয়ামে বিয’-এর রোজা ফরজ ছিল। তাফসিরে ইবনে কাসিরে বর্ণিত আছে, হজরত নূহ (আ.)-এর যুগে প্রত্যেক মাসে তিনটি রোজা পালনের বিধান ছিল। তাফসিরবিদ হজরত কাতাদাহ (র.) বলেন, মাসে তিন দিন রোজা রাখার বিধান হজরত নূহ (আ.)-এর যুগ থেকে শুরু করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ পর্যন্ত বলবৎ ছিল।
মুসলিম মিল্লাতের পিতা সহিফাপ্রাপ্ত নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর যুগে ৩০টি সিয়াম ছিল বলে কেউ কেউ লিখেছেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পর আসমানি কিতাব ‘তাওরাত’প্রাপ্ত প্রসিদ্ধ নবী হজরত মুসা (আ.)-এর যুগেও সিয়াম ছিল। ইহুদিদের ওপর প্রতি শনিবার বছরের মধ্যে মহররমের ১০ তারিখে আশুরার দিন এবং অন্যান্য সময় রোজা ফরজ ছিল। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করে ইহুদিদের আশুরার দিনে রোজা অবস্থায় পেলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজকে তোমরা কিসের রোজা করছ?’ তারা বলল, ‘এটা সেই মহান দিন যেদিন আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর কওমকে (বনী ইসরাইল) মুক্ত করেছিলেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে নীল দরিয়ায় ডুবিয়ে মেরেছিলেন। ফলে শুকরিয়াস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) ওই দিনে রোজা রেখেছিলেন, তাই আমরা আজকে রোজা করছি।’ এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমি তোমাদের অপেক্ষা হজরত মুসা (আ.)-এর অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিন সওম পালন করেন এবং সবাইকে রোজা রাখার নির্দেশ দেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহর কাছ থেকে তাওরাতপ্রাপ্তির আগে ৪০ দিন পানাহার ত্যাগ করেছিলেন। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতে বর্ণিত আছে, হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে ৪০ দিন পানাহার না করে কাটিয়েছিলেন। তাই ইহুদিরা সাধারণভাবে হজরত মুসা (আ.)-এর অনুসরণে ৪০টি রোজা রাখা ভালো মনে করত। তন্মধ্যে ৪০তম দিনটিতে তাদের ওপর রোজা রাখা ফরজ ছিল। যা ইহুদিদের সপ্তম মাস তিসরিনের দশম তারিখে পড়ত। এ জন্য ওই দিনটিকে আশুরা বা দশম দিন বলা হয়। এ আশুরার দিনে হজরত মুসা (আ.) তাওরাতের ১০টি বিধান পেয়েছিলেন। এ কারণেই তাওরাতে ওই দিনের রোজার অত্যন্ত তাগিদ এসেছে। এ ছাড়া ইহুদি সহিফাতে অন্যান্য রোজারও সুস্পষ্ট হুকুম রয়েছে।
আসমানি কিতাব ‘যবুর’প্রাপ্ত বিখ্যাত নবী হজরত দাউদ (আ.)-এর যুগেও রোজার প্রচলন ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় রোজা হজরত দাউদ (আ.)-এর রোজা। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন এবং এক দিন বিনা রোজায় থাকতেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) অর্থাৎ হজরত দাউদ (আ.) অর্ধেক বছর রোজা রাখতেন এবং অর্ধেক বছর বিনা রোজা থাকতেন।
আসমানি কিতাব ‘ইঞ্জিল’প্রাপ্ত বিশিষ্ট নবী হজরত ঈসা (আ.)-এর যুগে রোজার প্রমাণ পাওয়া যায়। হজরত ঈসা (আ.)-এর অনুসারী সম্প্রদায় রোজা রাখতেন। হজরত ঈসা (আ.) তাঁর ধর্ম প্রচার শুরুতে ইঞ্জিল পাওয়ার আগে জঙ্গলে ৪০ দিন সিয়াম সাধনা করেছিলেন। একদা হজরত ঈসা (আ.)-কে তাঁর অনুসারীরা জিজ্ঞেস করেন যে, ‘আমরা অপবিত্র আত্মাকে কী করে বের করব?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘তা দোয়া ও রোজা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বের হতে পারে না।’ (মথি ৭-৬৬, সিরাতুন নবী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৮৭-২৮৮) খ্রিষ্টানদের জন্য রোজা পালনের বিধান ছিল। খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ফেরাউনের নীল নদে নিমজ্জিত হওয়ার দিন রোজা রাখত। পরে এর সঙ্গে সংযোগ করতে করতে রোজার সংখ্যা পঞ্চাশে গিয়ে পৌঁছে। পবিত্র বাইবেলে রোজাব্রত পালনের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি ও কঠোর সংযম সাধনার সন্ধান পাওয়া যায়।
ইসলামের সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত লাভের আগে আরবের মুশরিকদের মধ্যেও সিয়ামের প্রচলন ছিল। যেমন আশুরার দিনে কুরাইশরা জাহেলি যুগে রোজা রাখত এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) জাহেলি যুগে ওই রোজা রাখতেন। অতঃপর যখন তিনি মদিনায় আগমন করেন তখন ওই রোজা নিজে রাখেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে রোজা রাখার হুকুম দেন। পরিশেষে মাহে রমজানের সিয়াম যখন ফরজ হয় তখন তিনি আশুরার রোজা ছেড়ে দেন। (বুখারি ও মুসলিম) ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিন দিন রোজা রাখার বিধান ছিল। পরে দ্বিতীয় হিজরি সালে উম্মতে মুহাম্মদির ওপর মাহে রমজানের রোজা ফরজ হলে তা রহিত হয়ে যায়।
বিভিন্ন জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার মধ্যেই রোজা পালনের ইতিহাস পাওয়া যায়। বেদের অনুসারী ভারতের হিন্দুদের মধ্যেও ব্রত অর্থাৎ উপবাস ছিল। প্রত্যেক হিন্দি মাসের ১১ তারিখে ব্রাহ্মণদের ওপর ‘একাদশীর’ উপবাস রয়েছে। এ হিসাবে তাদের উপবাস ২৪টি হয়। কোনো কোনো ব্রাহ্মণ কার্তিক মাসে প্রত্যেক সোমবার উপবাস করেন। কখনো হিন্দু যোগীরা ৪০ দিন পানাহার ত্যাগ করে চল্লিশে ব্রত পালন করেন। প্রাচীন চীনা সমপ্র্রদায়ের লোকেরা একাধারে কয়েক সপ্তাহ রোজা পালন করত এবং খ্রিষ্টান পাদরিদের ও পারসিক অগ্নিপূজকদের এবং হিন্দু যোগী ইত্যাকার ধর্মাবলম্ব্বীদের মধ্যে রোজার বিধান ছিল। পারসিক ও হিন্দু যোগীদের রোজার ধরন ছিল এরূপ—তারা রোজা থাকা অবস্থায় মাছ-মাংস, সবজি, তরকারি ইত্যাদি ভক্ষণ করা থেকে বিরত থাকত বটে; কিন্তু ফল-মূল এবং সামান্য পানীয় গ্রহণ করত। এ ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রোজা পালনের ধারা অব্যাহত ছিল। মানবশুদ্ধির জন্য আদিম যুগ থেকেই অনেক গোত্র, বর্ণ, সমপ্র্রদায় এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে রোজা প্রচলিত ছিল। যদিও ধরন ও প্রক্রিয়াগতভাবে এতে কেবল সংখ্যা, নিয়মকানুন ও সময়ের ব্যবধান কিছুটা ভিন্নতর ছিল।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.