অবহেলায় পড়ে আছে কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার by মমিনুল ইসলাম মঞ্জু

গওহর পার্ক ময়দান। খোলামেলা এ ময়দানটি ছিল তখনকার কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরের খেলাধুলা আর জনসমাবেশের একমাত্র মাঠ। এখনকার পুরনো শহরের মোল্লাপাড়ায় কুড়িগ্রাম-ভূরুঙ্গামারী সড়কঘেঁষা এই মাঠে ঢোকার বাঁ পাশে ছিল বড় শিমুল গাছ।


এ গাছের নিচে ৫৯ বছর আগে কয়েকজন সাহসী ও প্রগতিশীল শিক্ষার্থী কাদা দিয়ে ইট গেঁথে তৈরি করেছিলেন প্রথম শহীদ মিনার। শহীদ মিনারটির অবয়ব এখনও একই রকম আছে, শুধু বেদির জায়গা একটু বেড়েছে এবং কাদার বদলে লাগানো হয়েছে সিমেন্ট। দু'যুগ আগেও শহীদ মিনারটি ছিল শহীদ দিবস পালনসহ কুড়িগ্রামের সব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ভাষার মাসে লাল শিমুল ফুলে ঢাকা থাকত এর বেদি। এখন শহীদ মিনারটি পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। শিমুল গাছটিও এখন আর নেই। শহীদ মিনারের পেছনের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দোকান। এরশাদ শাসনামলে গওহর পার্কজুড়ে তার মায়ের নামে গড়ে তোলা হয়েছে মজিদা আদর্শ ডিগ্রি কলেজ। ফলে গওহর পার্ক ময়দানের নামটি মুছে গেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ মাঠটি প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলেছেন। মাঠটি এখন মজিদা কলেজের মাঠ হিসেবে পরিচিত। কলেজের প্রধান ফটকের পাশে প্রাচীর ঘেঁষে সামান্য একটু জায়গায় শহীদ মিনারটির অস্তিত্ব টিকে আছে কোনোরকমে।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় কুড়িগ্রাম ছিল মহকুমা। সে সময় এখানে কোনো কলেজ ছিল না। কুড়িগ্রাম হাইস্কুলের ছাত্ররাই সব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিত। ঢাকায় ভাষা আন্দোলন ও ২১ ফেব্রুয়ারির শোকাবহ ঘটনা এখানকার মানুষ জানতে পেরেছিলেন দু'দিন পর। এরও ক'দিন পর রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যয়নরত কুড়িগ্রামের কয়েক ছাত্র এখানে এসে উদ্বুদ্ধ করলে হাইস্কুলের প্রগতিশীল কিছু ছাত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাষা আন্দোলনে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনের প্রথম সমাবেশ করে বাজারের কালীবাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায়। এরই ধারাবাহিকতায় আমানউল্লাহ আহমেদ, সোলায়মান আলী, আবদুল করিম সরকার, আমজাদ হোসেন, বাদল রুদ্র, বুদ্ধদেব সরখেল, আবদুল হামিদ, আবদুল আহাদসহ ক'জন ছাত্র ঝুঁকি নিয়ে ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চুপিসারে প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মাণ করেন। এরাই ছিলেন কুড়িগ্রামে ভাষা আন্দোলনের পুরোধা। তাদের মধ্যে একমাত্র আবদুল করিম সরকার এখনও বেঁচে আছেন। তিনি জেলা বারের বয়ঃজ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন মোস্তফা-বিন-হোসেন খন্দকার, কেএস আলী আহমেদ, একেএম সামিউল হক নান্টু, তোফায়েল হোসেন, এটিএম আফজাল হোসেন দুলাল এবং হবিবর রহমান খোকা। তাদের মধ্যে বেঁচে আছেন কেএস আলী আহমেদ এবং একেএম সামিউল হক নান্টু। পরে তারা সবাই মিলে ১৯৫৬ সালে কাদামাটি দিয়ে গাঁথা ইটের শহীদ মিনারটি সিমেন্ট দিয়ে পাকা করেন।
১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহীদ মিনারটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির কয়েকদিন আগে ছাত্রলীগ সভাপতি শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম মণ্ডল, মোকাররম হোসেন সাচ্চু, রুকুনুদ্দৌলা মণ্ডল, নুর ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম টুকুসহ অন্য নেতারা আগের কাঠামো অনুযায়ী শহীদ মিনারটি পুনর্নির্মাণ করেন।
১৯৮৬ সালে পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের কেন্দ্রস্থল ঘোষপাড়া এলাকায় তিন রাস্তার মোড়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে। তখন থেকে নতুন এ শহীদ মিনারটি ঘিরে সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে। ফলে প্রথম নির্মিত শহীদ মিনারে মানুষের যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। গুরুত্বহীন পড়ে শহীদ মিনারটি। পৌর কর্তৃপক্ষ এটি সংরক্ষণ এবং সংস্কারের দায়িত্ব কোনো সময় নেয়নি। ভাষা আন্দোলনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সংরক্ষণেও কেউ এগিয়ে আসেননি। জেলার ইতিহাস নিয়ে প্রকাশিত দু'তিনটি বইয়েও ভাষা আন্দোলনের এ ইতিহাস স্থান পায়নি।
পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা শহীদ মিনারটির সামনে দিয়ে প্রতিদিন শত শত ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক যাতায়াত করেন। বেদিতে বসে আড্ডাও দেন ছাত্রছাত্রীরা। তারা কেউ জানেন না এটি কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার। এর সঙ্গে মিশে আছে কুড়িগ্রামের ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস।
মমিনুল ইসলাম মঞ্জু : কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি, সমকাল
 

No comments

Powered by Blogger.