অর্থনীতি-মুদ্রাস্ফীতি বনাম মূল্যস্ফীতি by ফারুক মঈনউদ্দীন

দেশের সার্বিক অর্থনীতি বিষয়ে সাধারণ শিক্ষিত মানুষ, অর্থনীতিবিদ, ভোক্তাসাধারণ—সবার আলোচনায় যে কথাগুলো ঘুরেফিরে আসে, তা হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বা মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি। এই দুটি ধারণার সাধারণীকৃত ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে সামান্য বিভ্রান্তি।


আমরা যখন মুদ্রাস্ফীতি কথাটা ব্যবহার করি, তার সঙ্গে মূল্যস্ফীতির ধারণাকে এক করে ফেলি। অবশ্য এই বিভ্রান্তির কারণও আছে। মুদ্রাস্ফীতি বলতে অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধিকেই বোঝানো হয়। অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে গেলে এবং পণ্য ও সেবার সরবরাহ অপরিবর্তিত থাকলে মূল্যস্ফীতি ঘটে। কারণ অনেক বেশি টাকা সীমিত পণ্য ও সেবার পেছনে ধাওয়া করে। এতে চাহিদা ও মূল্যস্তর—দুটিই বেড়ে যায়। শাস্ত্রীয় ও আভিধানিক অর্থেও মুদ্রাস্ফীতির অর্থ সব ধরনের পণ্য ও সেবামূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি, যা সাধারণত ঘটে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে, যাতে অর্থের মূল্য হ্রাস পায়। বলা হয়, ‘মুদ্রাস্ফীতিতে সবকিছু মহার্ঘ হয়ে যায় কেবলমাত্র অর্থের মূল্য ছাড়া।’ সাধারণ অর্থে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে মূল্যস্ফীতির এটিই সহজবোধ্য সম্পর্ক এবং মুদ্রাস্ফীতির স্বাভাবিক ধর্মটিও এ রকম। কিন্তু একে সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য করা যায় না।
প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্তর কমলেও মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করতে পারে; আবার মুদ্রাস্ফীতি না থাকলেও মূল্যস্তর বাড়তে পারে। এককথায়, মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতিতে এর একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং এর প্রবণতা কোন দিকে যাবে, তা নির্ভর করে একাধিক নিয়ামকের ওপর। যেমন, বর্তমান যুগে প্রযুক্তির উৎ কর্ষের সঙ্গে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রী কিংবা মোবাইল ফোন সেটের দাম কমে আসছে এবং সেটা ঘটতে পারে মুদ্রাস্ফীতি বিরাজমান অর্থনীতিতেও। আবার একটা মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিতে কোনো বিশেষ পণ্য বা সেবার মূল্য বাড়তে পারে, যদি এর চাহিদা কারণবশত হঠাৎ বেড়ে যায়। যেমন আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতির বিপরীত অবস্থা অর্থাৎ মন্দাভাবও যদি বিরাজ করে, তবু ভূসম্পত্তি কিংবা অ্যাপার্টমেন্টের মূল্যস্ফীতি থেমে থাকবে না। কারণ, এর রয়েছে বিশাল চাহিদা, সীমিত সরবরাহ এবং অর্থায়ন প্রাপ্তির সুবিধা।
মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে আরেকটি বিষয় গুলিয়ে ফেলা হয়। সেটা হচ্ছে ভোক্তা মূল্যসূচক। এটি মূলত মূল্যহার পরিবর্তনের হিসাব, যা দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপ করা হয়। এই হিসাবের জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট বছরকে ভিত্তি বছর হিসেবে ধরা হয়। তারপর সেই ভিত্তি বছরকে বিবেচনায় রেখে একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্যস্তর পর্যবেক্ষণ করে রেকর্ড রাখা হয়। ধরা যাক, মুদ্রাস্ফীতির হার নির্ণয়ের জন্য কেবল একটি পণ্যের মূল্যের ওপর ভোক্তা মূল্যসূচক নির্ধারণ করা হয়। এবং ভিত্তি বছর ২০০০ সালে সেই পণ্যটির দাম ছিল এক টাকা এবং এর মূল্যসূচক ১০০। পরের বছর (২০০১) সেই পণ্যটির দাম যদি বেড়ে দাঁড়ায় এক টাকা ২০ পয়সায়, তাহলে মূল্যসূচক হবে ১২০। এখন আমরা ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যদি মুদ্রাস্ফীতি নির্ণয় করতে চাই এবং ২০১১ সালে সেই পণ্যটির মূল্যসূচক যদি হয় ১৫০, তাহলে এই ১০ বছরে মুদ্রাস্ফীতির হার হবে (১৫০-১২০)—১২০ = ০.২৫, অর্থাৎ শতকরা হিসাবে ২৫ শতাংশ। এ রকম কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ভোক্তা মূল্যসূচক ব্যবহার করে মুদ্রাস্ফীতির হার নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট বা একক পণ্যের তুলনামূলক মূল্যবৃদ্ধিকে মুদ্রাস্ফীতি বলা যায় না, যদিও একে সাধারণ মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে এক করে দেখা হয়। কোনো একক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে সেই পণ্যের বাড়তি চাহিদা কিংবা সরবরাহ ঘাটতির কারণে। অথচ সাধারণ মূল্যস্ফীতি তথা মুদ্রাস্ফীতি চাহিদা সরবরাহের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। এটি নির্ভর করে অর্থনীতির ভাষায় ‘সামগ্রিক চাহিদা’র ওপর। সামগ্রিক চাহিদা বলতে বোঝায়, একটি অর্থনীতিতে পণ্য ও সেবার ওপর সব ভোক্তার মোট ব্যয়, মোট বিনিয়োগ ব্যয়, মোট সরকারি ব্যয় এবং নিট রপ্তানি আয় (আমদানি ব্যয় বাদ দিয়ে)—সবকিছুর সমষ্টি। আর এই সামগ্রিক চাহিদা প্রভাবিত হয় মুদ্রা সরবরাহ দ্বারা। অতএব, মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে একটি মুদ্রানৈতিক বিষয় এবং এর পেছনে কোনো একক পণ্যের সরবরাহ ঘাটতির কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সেই পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধির পরও মূল্যস্ফীতি না ঘটে মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করতে পারে কিংবা উভয়ই ঘটতে পারে। যেমন, কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে ব্যাপক হারে বেড়েছে মুরগি ও ডিমের উৎ পাদন। কিন্তু এতে কি মূল্য কমেছে? নাকি বেড়েছে? সুতরাং, কোনো একক পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি কিংবা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সঠিক সংজ্ঞার মুদ্রাস্ফীতিই কেবল সঠিক মুদ্রানীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং সেটি যদি হয় চাহিদাজাত মূল্যস্ফীতি। তাহলে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আরেকটি প্রসঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই চলে আসছে। সেটি হচ্ছে দেশের মুদ্রানীতি, যা নিয়ন্ত্রণ করে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রানীতি হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে অর্থনীতির গতি ও প্রবৃদ্ধিকে ঠিক পথে চালানোর জন্য মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যা মূলত করা হয় অর্থ সরবরাহ এবং সুদের হারের মাধ্যমে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, মুদ্রানীতি দিয়ে অর্থনীতির মোট চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে চাহিদাজাত মুদ্রাস্ফীতিকে বাগে আনার চেষ্টা করা যায়। চাহিদা ব্যবস্থাপনার এই প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল্যস্তর ও বিনিয়োগ স্থিতিশীল রাখা। মুদ্রানীতির এই কৌশল প্রয়োগ করা হয় সুদের হার এবং অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সামগ্রিক চাহিদাকে বশে রাখার জন্য। অর্থ সরবরাহ এবং ঋণ নিয়ন্ত্রণ করলে মুদ্রাবাজারে স্বল্প মেয়াদে সুদ বেড়ে যায় এবং ব্যাংকের বাড়তি তহবিল সংগ্রহের কারণে দীর্ঘ মেয়াদে আমানত এবং ঋণের ওপর সুদ বেড়ে যায়। এতে বিনিয়োগ কমে যায়। আর এ কারণে অর্থনীতিতে হ্রাস পায় সামগ্রিক চাহিদা। হ্রাসকৃত বিনিয়োগের জন্য মানুষের ভোগও কমে যায়, যা আবার প্রভাব ফেলে সামগ্রিক চাহিদার ওপর। এতে দেখা যায়, ঋণ সংকোচন করে বিনিয়োগ, মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা কমানো যায়, যে প্রক্রিয়ায় একসময় বশে আসে মুদ্রাস্ফীতি।
তবে আজকাল মুদ্রানীতির এই উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা নতুনভাবে আলোকপাত করছেন। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ওয়াই ভি রেড্ডি লেখেন, ‘মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য এখন আর মূল্যস্তর স্থিতিশীল রাখায় সীমাবদ্ধ নেই...। এর উদ্দেশ্য এখন আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা পর্যন্ত বিস্তৃত।’
আটলান্টা ফেডারেল রিজার্ভের প্রেসিডেন্ট ডেনিস লকহার্ট বলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতি সবকিছুর মূল্য বাড়ায়। এটা কোনো একক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা কোনো বিশেষ শ্রেণীর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নয়।’
তাঁর মতে, নির্দিষ্ট বাজারে পণ্যমূল্যকে নিয়মানুগভাবে প্রভাবিত করতে অক্ষম মুদ্রানীতি একটা ভোঁতা অস্ত্র। তাঁর মতে, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওঠানামা এবং কোনো একক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে অক্ষম। আমরা তেল উৎ পাদন করি না। খাদ্যও ফলাই না। কিংবা দিই না স্বাস্থ্যসেবা। যেসব ঘটনা কোনো কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং আপনাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণ ঘটায়। যেমন, তেলের অনাগত ধাক্কা কিংবা খরা অথবা ধর্মঘট—এসব আমরা ঠেকাতে পারি না।’
‘অতএব বাজারধর্মে ঘটা পণ্যের তুলনামূলক মূল্য সংশোধন ঠেকানো মুদ্রানীতির কাজ নয়। এর কাজ হচ্ছে অর্থনীতিতে সব মূল্য পরিবর্তনের সামগ্রিক লক্ষ্য ও গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা।’ সে কারণেই আমরা দেখতে পাই, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সুদের হার কিংবা ব্যাংকগুলোর নগদ জমা ও তারল্য হার বাড়ায়, সেটা বাজারের কোনো পণ্যের দাম কমাতে পারে না। তাহলে প্রশ্ন করা যায়, মুদ্রানীতি যদি জীবনযাত্রার ব্যয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে এই নীতির দরকার কী? লকহার্ট এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, দরকারটি হচ্ছে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা এবং দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থিরতা আনা, যা সম্ভব আর্থবাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষার মাধ্যমে।
আমাদের দেশেও যখন ষাণ্মাষিক মুদ্রানীতি ঘোষিত হয়, তখন বিভিন্ন মহল থেকে আশা করা হয়, এটি দিয়ে অর্থনীতির সব সমস্যা, যেমন শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে দ্রব্যমূল্য, বিদেশি বিনিয়োগ থেকে শুরু করে টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময়মূল্য—সবকিছুর সমাধান করে ফেলা যাবে। মুদ্রানীতির কর্মক্ষেত্র যেহেতু চাহিদা ব্যবস্থাপনা, এটি অর্থনীতির সরবরাহ ক্ষমতার ওপর কার্যকর নয়। এটি দিয়ে সামগ্রিক চাহিদাকে প্রভাবিত করে এর হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানো যায়, আর এটি করা হয় সুদের হারের তারতম্য ঘটিয়ে।
এই সত্য থেকে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তা হচ্ছে, কেবল চাহিদাজাত মূল্যস্ফীতিকে মুদ্রানীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু যে মূল্যস্ফীতি ব্যয়বৃদ্ধিজনিত, সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে মুদ্রানীতি অক্ষম। যেমন আমাদের অর্থনীতিতে খাদ্যমূল্যস্ফীতি কিংবা মুদ্রাস্ফীতি—যা-ই বলা হোক না কেন, ঘটে বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে, কখনোই চাহিদা বৃদ্ধির কারণে নয়, যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে চাহিদা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। সুতরাং মুদ্রানীতি দিয়ে চাহিদা ব্যবস্থাপনা করে খাদ্য কিংবা কোনো একক পণ্যমূল্য কমানো সম্ভব নয়। এর আরও একটি কারণ হচ্ছে, খাদ্যের অস্থিতিস্থাপক চাহিদা। অর্থাৎ খাদ্যের দাম যা-ই হোক না কেন, মানুষকে তার মৌলিক চাহিদার প্রধানতমটি, অর্থাৎ খাদ্যচাহিদা মেটাতে হবে। কিন্তু খাদ্য ছাড়া অন্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি কম থাকলেও সার্বিক মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে খাদ্যমূল্যের ওপর। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যমূল্যের প্রবণতার ওপর নির্ভর করবে অভ্যন্তরীণ খাদ্যমূল্য এবং তা ঊর্ধ্বমুখী থাকার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের দেশে কিংবা ভারতে বিগত বছরগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি বাগে রাখার জন্য ক্রমাগত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এর কোনো সুফল পাওয়া যায়নি, যা প্রমাণ করে যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
তাহলে শেষ পর্যন্ত যে কথাটি বোঝা যাচ্ছে, দেশের মুদ্রানীতি যা-ই হোক না কেন, খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ মূল্য নির্ধারিত হবে আন্তর্জাতিক বাজারের দাম ও চাহিদার স্থিতিস্থাপকতার ওপর, অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর নয়। অতএব, মূল্যসূচক নির্ধারণের জন্য খাদ্যপণ্য প্রধানতম সামগ্রী হলেও এর মূল্য দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নির্ণয় করলে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.