চরাচর-বাংলা একাডেমীতে নেই কোনো শহীদ মিনার by স্বপন কুমার দাস

ঢাকার যেসব পুরনো ভবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতির আবেগ-উচ্ছ্বাস, তার মধ্যে বর্ধমান হাউস অন্যতম। এ ভবনে বসেই তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার প্রতি পুলিশকে গুলি করার নির্দেশ দেন।
পরবর্তীকালে এ ভবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে বাংলা একাডেমী। আজকে ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা আয়োজিত হয়, তাও এই ভবনকে কেন্দ্র করেই। অথচ আজও বাংলা একাডেমীতে শহীদের স্মরণে নির্মিত হয়নি কোনো শহীদ মিনার। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ আইন রদ হওয়ার পর ঢাকায় গভর্নরের নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের থাকার জন্য যেসব দৃষ্টিনন্দন বাড়ি নির্মিত হয়, বর্ধমান হাউস তার অন্যতম। বর্ধমানের রাজা স্যার বিজয় চাঁদ ম্যাকার্থি ছিলেন গভর্নরের নির্বাহী পরিষদের সদস্য। ঢাকায় তাঁর থাকার জন্য এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এ কারণে ভবনটির নামকরণ হয় বর্ধমান হাউস। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর এ ভবনটি পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পূর্ব বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এ ভবনে ওঠেন খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দিনের পর পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বর্ধমান হাউসে ওঠেন নুরুল আমিন। তিনিও বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করেন। এ ভবনে বসেই নুরুল আমিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন পুলিশকে। ফলে এ ভবনটির প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও ঘৃণার সৃষ্টি হয়। দাবি ওঠে আর কোনো মুখ্যমন্ত্রীকে এ ভবনে বাস করতে দেওয়া হবে না। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবির মধ্যে একটি দাবি ছিল বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমীতে রূপান্তরের। নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমী। সেদিন যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার বাংলা একাডেমী উদ্বোধন করেন। বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার পর এই প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের প্রভূত বিকাশ ঘটে। ষাটের দশকে বর্ধমান হাউসের পেছনে নির্মিত হয় বাংলা একাডেমীর প্রশাসনিক ভবন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমীকে কেন্দ্র করে প্রচলন হয় অমর একুশে বইমেলা। বিগত জোট সরকারের সময় একাডেমী প্রাঙ্গণে নির্মিত হয় ভাষাশহীদের প্রতিকৃতি 'মোদের গরব'। বর্তমান মহাজোট সরকারের সময় বর্ধমান হাউসে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর। ওই ভবনের নিচতলায় এ বছর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জাতীয় সাহিত্য ও লেখক জাদুঘর। বর্তমানে বাংলা একাডেমীর দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে প্রশাসনিক ভবন, অডিটরিয়াম, লাইব্রেরি ইত্যাদি। কিন্তু ৬২ বছর পরও ভাষাশহীদের জন্য বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়নি কোনো শহীদ মিনার। অথচ ঢাকা নগরীতে বহু প্রতিষ্ঠানে রয়েছে নিজস্ব শহীদ মিনার। সম্প্রতি শিক্ষাভবনে ভাষাশহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত হচ্ছে শহীদ মিনার। কিন্তু বাংলা একাডেমীর মতো কুলীন প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো শহীদ মিনার। ফলে নিজস্ব শহীদ মিনার না থাকায় প্রতি বছর বাংলা একাডেমীর বহু কর্মকর্তা-কর্মচারী ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান থেকে বঞ্চিত থাকেন। এ সময় বইমেলায় দায়িত্ব থাকায় তাঁদের পক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন সম্ভব হয় না। বাংলা একাডেমীতে শহীদ মিনার নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।
স্বপন কুমার দাস

No comments

Powered by Blogger.