সাহসী ঘোড়সওয়ার by সোহরাব হাসান

ফয়েজ আহ্মদকে তাঁর সাংবাদিক সতীর্থরা মধ্যরাতের অশ্বারোহী হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন। একসময় তিনি ডাকসাইটে রিপোর্টার ছিলেন। রিপোর্টের খোঁজে সারা শহর চষে বেড়িয়েছেন। সেসব দিনের অভিজ্ঞতা লিখেছেন মধ্যরাতের অশ্বারোহীতে। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লেখাটি ধারাবাহিক ছাপা হলে পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায়। এরপর বের হয় সত্য বাবু মারা গেছেন, নগরে নন্দিনী।


কিন্তু ফয়েজ আহ্মদ, আমাদের প্রিয় ফয়েজ ভাই তো কেবল মধ্যরাতের অশ্বারোহী ছিলেন না। ছিলেন ইতিহাসের সাহসী ঘোড়সওয়ার। গেল শতকের ’৪৭ থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত—এই ভূখণ্ডে এমন কোনো গণসংগ্রাম বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়নি, যার সঙ্গে এই মানুষটি নিজেকে যুক্ত করেননি। কোনোটিতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, কোনোটিতে সহযাত্রীর ভূমিকা পালন করেছেন।
আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচারী শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক সমাবেশে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও আলপনা আঁকাকে বেদাত কাজ বলে অভিহিত করেছিলেন (আজ সেই এরশাদই প্রগতিশীল মহাজোটের শরিক!)। এর প্রতিবাদে লেখক-শিল্পী, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিসেবীরা গড়ে তুললেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ফয়েজ অহ্মদ হলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁর নেতৃত্বে সংগঠনটি দেশের সব মত ও পথের সংস্কৃতিসেবীদের একত্র করেছিল। ছাত্র, তরুণ ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতিরোধের কারণেই ক্ষমতায় থাকতে এরশাদ কখনোই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতে পারেননি, তাঁর জন্য জাতীয় প্রেসক্লাবের দরজাও ছিল বন্ধ। এরপর এরশাদ নিজেকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচে কবি সম্মেলন ও বঙ্গভবনে কবিতা পাঠের আসর বসালেও দেশের প্রগতিশীল কবিরা তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠিত হয়, তাঁরও প্রাণপুরুষ ছিলেন ফয়েজ আহ্মদ। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১—টানা পাঁচ বছর তিনি জাতীয় কবিতা উৎসবের আহ্বায়ক ছিলেন।
কেবল সংস্কৃতি বা সাংবাদিকতা নয়, ফয়েজ আহ্মদের কর্মতৎপরতা বিস্তৃত ছিল সাহিত্য-শিল্প, রাজনীতিসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে। কিশোর বয়স থেকেই তিনি সংবাদিকতার পাশাপাশি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ঝগড়া এড়িয়ে যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বামপন্থায় তাঁর গভীর আস্থা ছিল।
অন্যান্য স্বৈরশাসকের মতো এরশাদও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখার অপকৌশল নেন। তিনি জানতেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক হলেই তাঁর ক্ষমতার ভিত নড়বড়ে হয়ে যাবে। প্রথমে তিনি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে দুই দলের সুবিধাবাদী নেতাদের দলে টানেন, মন্ত্রী করেন। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগকে বিএনপির বিরুদ্ধে এবং বিএনপিকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে সচেষ্ট থাকেন।
তখন দেশের সচেতন মানুষ, নাগরিক সমাজ বুঝতে পারল, স্বৈরশাসককে হটাতে হলে দুই দলের মধ্যে মতৈক্য জরুরি। যুগপৎ আন্দোলনের ঘেরাটোপ থেকে দুই দলের শীর্ষ নেত্রীকে এক টেবিলে বসাতে হবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? কে দুই নেত্রীর সঙ্গে কথা বলবে? এগিয়ে এলেন ফয়েজ আহ্মদ। তিনি একবার ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন, আরেকবার ৬ মইনুল হোসেন রোডে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর দূতিয়ালিতেই ১৯৮৭ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সরকারি নিবাসে দুই নেত্রীর বৈঠক ও যুক্ত ঘোষণা সম্ভব হয়েছিল। এরপর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোল বেগবান হয়। এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে ফয়েজ আহ্মদকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। হুলিয়া মাথায় নিয়ে দিনের পর দিন পলাতক থাকতে হয়েছে। কারাভোগ করতে হয়েছে।
স্বৈরাচারের পতনের পর ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক-দালালবিরোধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতেও সক্রিয় ছিলেন ফয়েজ আহ্মদ। গোলাম আজমের বিচারের দাবিতে সে বছর ২৬ মার্চ প্রতিষ্ঠিত গণ-আদালতের অন্যতম বিচারক ছিলেন তিনি। যার কারণে বিএনপি সরকার অন্যান্যের সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেছিল।
১৯৪৮ সালে সাংবাদিকতা শুরু করে ফয়েজ আহ্মদ ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ, পূর্বদেশ ও ইনসাফ-এ কাজ করেন। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ১৯৫০ সালে দিল্লি সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেন। এ বছরই তাঁর সম্পাদনায় বের হয় হুল্লোড়। ১৯৬৬ সালে বেইজিং রেডিওতে বাংলা বিভাগ চালু হয় তাঁরই হাত ধরে। আটষট্টি-ঊনসত্তরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার রিপোর্ট করে তিনি ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ১৯৭০ সালে তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক স্বরাজ, যে পত্রিকায় বাঙালির স্বাধিকারের দাবির পাশাপাশি অস্ত্র চালনার কৌশলও প্রচার করা হতো।
ফয়েজ আহ্মদের অন্যতম কীর্তি শিল্পাঙ্গন। চিত্রকর্মের প্রতি এ দেশের মানুষের আগ্রহ বাড়াতে এবং শিল্পীদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এই প্রতিষ্ঠানটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
সব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে তাঁর নিরহংকারী জীবনাচরণ এবং গণতন্ত্র ও গণমানুষের মুক্তির সাধনা। এমনকি তাঁর অন্তিম ইচ্ছায়ও গণমানুষের কল্যাণ চিন্তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.