সাক্ষাৎকার সামির মেহতা-সাক্ষাৎকার গ্রহণ :শেখ রোকন-নদী রক্ষায় সীমান্তের দুই পাশের নাগরিক সমাজের ঐক্য জরুরি

নদী নিয়ে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংগঠন 'ইন্টারন্যাশনাল রিভারস'-এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক সামির মেহতা হিমালয় অঞ্চলে ড্যাম নির্মাণের বিরুদ্ধে পরিচিত কণ্ঠস্বর। তিনি ২০১০ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন।


এর আগে ভারতের বোম্বে হাইকোর্টের নির্দেশে তিনি মুম্বাইয়ের উপকূলীয় একটি নদীর জোয়ার-ভাটার ওপর উন্নয়ন কাজের প্রভাব নিয়ে কাজ করেন। ১৯৯১-২০০৮ সালে তিনি 'বোম্বে এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকশন গ্রুপে'র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সামির মেহতা ২০০৯ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট থেকে জনপ্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অব বোম্বে থেকে পরিসংখ্যানে স্নাতক হওয়ার পর তিনি প্রথমে একটি আইটি কোম্পানিতে প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে যোগ দিলেও পরে পরিবেশ বিষয়ে ক্যারিয়ার গঠন করেন


সমকাল : আমরা জানি, ইন্টারন্যাশনাল রিভারস বিশ্বব্যাপীই নদী এবং বিশেষ করে আড়ি বাঁধ বা ড্যাম নিয়ে কাজ করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আপনাদের ফোকাস কী?
সামির মেহতা : দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা মূলত বিভিন্ন উদ্যোগ ও গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করে থাকি। তাদের প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকি। সে ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আমাদের বিশেষ ফোকাস হচ্ছে তথ্য-উপাত্ত সুলভ করে তোলা। গোটা বিশ্বেই ইন্টারন্যাশনাল রিভারসের পক্ষে বিভিন্ন বিষয়ে_ যেমন নদীর এনভায়রনমেন্টাল ফ্লো, ভাটি অঞ্চলে ড্যামের বিরূপ প্রভাব (ডাউনস্ট্রিম এফেক্ট), ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজম, জলবায়ু পরিবর্তন_ গবেষণা, সমীক্ষা পরিচালিত হয়, প্রতিবেদন প্রণীত হয়ে থাকে। একই সঙ্গে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ড্যামের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ গ্রহণ, সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকি। ড্যামের বিকল্প সমাধানও নির্দেশ করি। দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা হিমালয় অঞ্চলে প্রবাহিত নদীগুলোতে নির্মিত ও নির্মীয়মাণ শত শত ড্যামের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজকে সোচ্চার এবং সংগঠিত করে তোলার পাশাপাশি সারাবিশ্বের অভিজ্ঞতা, সাফল্যগাথা সম্পর্কে তাদের জানাই। আমাদের গবেষণা, সমীক্ষা ও প্রতিবেদনগুলো এখানে প্রচার এবং কখনও কখনও এই অঞ্চলের ভাষায় প্রকাশ করে থাকি। এই অঞ্চল নিয়েও গবেষণা, সমীক্ষা পরিচালিত হচ্ছে।
সমকাল : হ্যাঁ, আমাদের মনে আছে, বছরতিনেক আগে আপনারা হিমালয় অঞ্চলের নির্মিত, নির্মীয়মাণ ও প্রস্তাবিত ৫৫২টি বাঁধ নিয়ে 'মাউন্টেন অব কংক্রিট' নামে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশেও ওই সমীক্ষা প্রচারিত হয়েছে। আপনার কাছে জানতে চাইব, যদিও অনেক উজানে, এসব বাঁধের কারণে বাংলাদেশে কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে?
সামির মেহতা : ৫৫২ বাঁধের সবগুলোর বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না। যেসব প্রবাহ চূড়ান্তভাবে ভাটিতে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সেগুলোর বিরূপ নিশ্চয়ই পড়বে। যত উজানেই হোক না কেন, সেটা ভারতে, নেপালে, ভুটানে বা চীনে_ অভিন্ন নদীতে যে কোনো ধরনের বাঁধের বিরূপ প্রভাব ভাটি অঞ্চলে পড়বেই। সেটা কেবল বাংলাদেশে নয়, ওইসব ড্যামের ভাটি অঞ্চল ভারতেও রয়েছে। সেখানেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। ড্যামের উজানেও বিরূপ প্রভাব পড়ে। যখন আপনি কংক্রিটের দেয়াল দিয়ে কোনো নদীর প্রবাহ বিঘি্নত করেন, উজান ও ভাটিতে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। নদীর উৎস অঞ্চল থেকে বদ্বীপ অঞ্চল পর্যন্ত ড্যামের বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে হিমালয় অঞ্চলের নদ-নদীতে যে শত শত কংক্রিটের বাঁধ তৈরি হচ্ছে তা গোটা অঞ্চলের পরিবেশ, বনভূমি, জীববৈচিত্র্য, পানিসম্পদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সমকাল : ক্ষতিকারক এসব ড্যামের ব্যাপারে ওই সমীক্ষার পর আপনারা আর কোনো উদ্যোগ বা কর্মসূচি কি নিয়েছেন?
সামির মেহতা : আমরা এখন এই সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছি। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এসব ড্যাম তৈরি হচ্ছে। আমরা দেখতে চাইছি এই অঞ্চলে জলবিদ্যুতের বিকল্প কী হতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি একটি সমাধান। নদীর প্রবাহ ও প্রতিবেশ বিঘি্নত না করে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জিও থার্মাল ব্যবহার করেও যে বিদ্যুতের চাহিতা মেটানো যেতে পারে, ড্যামের উদ্যোক্তাদের সে বিষয়টি দেখাতে চাইছি। আমরা সব ধরনের বিকল্পের দিকে নজর দিতে চাইছি।
সমকাল : হিমালয় অঞ্চলের এসব বাঁধের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ এবং বাংলাদেশে বহুল আলোচিত হচ্ছে টিপাইমুখ প্রকল্প। এ বাঁধটির বিষয়ে আপনারা কী ভাবছেন?
সামির মেহতা : না, টিপাইমুখ নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে কোনো কর্মসূচি নেই। বস্তুত দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা বিশেষ প্রকল্পভিত্তিক কোনো কাজ করছি না। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার কোথাও কোথাও আমরা কোনো কোনো বাঁধ বা নদী নিয়ে প্রকল্পভিত্তিক কাজ করছি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা সামগ্রিকভাবে ড্যামবিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছি।
সমকাল :ভারতে তো এসব ড্যামবিরোধী বিক্ষোভ চলছে।
সামির মেহতা : ঠিকই বলেছেন, আপনাকে বলতে পারি, প্রত্যেকটা ড্যামের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি অরুণাচলের লোয়ার ছুবনছিড়ির কথা বলেন, মণিপুরের টিপাইমুখের কথা বলেন, বিক্ষোভ কিন্তু থেমে নেই। স্থানীয় জনগোষ্ঠী এসব ড্যামের ঘোরতর বিপক্ষে। কারণ এসব ড্যামের কারণে তাদের নদী ধ্বংস হবে, বন ধ্বংস হবে। জীবন-জীবিকা ব্যাহত হবে। অনেক জনগোষ্ঠীর বাসস্থান চিরতরে হারিয়ে যাবে।
সমকাল : তারা কীভাবে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করছে? এসব বিক্ষোভের চরিত্র কি একই?
সামির মেহতা :মণিপুর ও আসামে টিপাইমুখ নিয়ে কী ধরনের বিক্ষোভ চলছে, তা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। যদি অরুণাচলের লোয়ার ছুবনছিড়ি নদীর (ব্রহ্মপুত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপনদী) ওপর নির্মিত বাঁধের কথা বলি, ড্যামটি অরুণাচলে অবস্থিত; কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব পড়বে আসামে। ফলে আসামের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। আপনি সেটাকে গণআন্দোলন বলতে পারেন। কেবল মিছিল-সমাবেশ নয়, এক পর্যায়ে তারা ছুবনছিড়ি ড্যাম সাইটমুখী সব উপকরণ পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। আপনি জানেন বোধহয়, অরুণাচলমুখী সব সড়কই আসামের ভেতর দিয়ে গেছে।
সমকাল :আমরা দেখছি এসব ড্যামের বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ হচ্ছে, নাগরিক সমাজ কাজ করছে; তারপরও ভারতীয় সরকার কেন ড্যাম নির্মাণে পিছপা হচ্ছে না?
সামির মেহতা : আপনি জানেন, ভারত এখন আট ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। সরকার সেটা আরও বাড়াতে চায়। এ জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট বিদ্যুৎ। আর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের কাছে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে সহজলভ্য হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলে ড্যাম দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা। আর দ্বিতীয় কারণটি বোধহয় হিমালয় অঞ্চলের নদীগুলোতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া।
সমকাল : হিমালয় অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ড্যামগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশের বিরূপ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে। এ নিয়ে এ দেশে আপনারা কী ধরনের কাজ করছেন?
সামির মেহতা : আপনাকে আগেই যেমনটি বললাম, ইন্টারন্যাশনাল রিভার দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো প্রকল্প বা বিশেষ এলাকাভিত্তিক কাজ করছে না। ড্যাম নিয়ে এর সার্বিক প্রভাব ও বিকল্প নিয়ে কাজ করছি আমরা। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশে বিরূপ প্রভাবের বিষয়টি বিবেচিত হয়ে থাকে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা যেসব নাগরিক জোটের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করছি, বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করছি, তার মধ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) রয়েছে। আমরা চাই, বাংলাদেশে ড্যামবিরোধী নাগরিক আন্দোলন শক্তিশালী হোক।
সমকাল : ইন্টারন্যাশনাল রিভারসে যোগ দেওয়ার আগেও আপনি পরিবেশ নিয়ে কাজ করেছেন, বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ে আপনার জানাশোনা রয়েছে। আপনি জানেন, ভারতের টিপাইমুখ প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। একজন পরিবেশ কর্মী হিসেবে আপনার কাছে জানতে চাইব, টিপাইমুখ ইস্যুতে আসলে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত?
সামির মেহতা :আমার মনে হয়, প্রথম কাজ হচ্ছে এই ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে খুব জোরালো, খুব নিবিড় অ্যাডভোকেসি করা। কারণ, এবার ঢাকায় এসে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, খুব সম্ভবত এই ধরনের ইস্যুতে ভারতীয় সরকারের সঙ্গে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে দরকষাকষি সম্ভব হচ্ছে না। এখন যে ধারায় আলোচনা চলছে, তার চেয়ে আরও জোর দিয়ে করা উচিত। দ্বিতীয় এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, নদীগুলো রক্ষায় সীমান্তের দুই পাশের নাগরিক সমাজের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। তাদের একত্রে বসে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে ইতিমধ্যেই এ ধরনের উদ্যোগ শুরু হয়েছে, আপনি জানেন। এখন এটাকে শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজকে দেশের ভেতরে ও বাইরেও পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে, দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টিও জরুরি বলে আমি মনে করি।
সমকাল :অনেক ধন্যবাদ।
সামির মেহতা : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
 

No comments

Powered by Blogger.