মত দ্বিমত-জনদুর্ভোগ প্রতিকারের জন্যই হরতাল by মাহবুবউল্লাহ

তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল আজ হরতাল পালন করছে। এর আগে গত সোমবার বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। কর্মীরা কয়েকটি বাসেও আগুন দিয়েছেন। অন্যদিকে পুলিশ সারা দেশে জামায়াতের কয়েক শ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।


দেশের চলমান রাজনীতি বিশ্লেষণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদ ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুবউল্লাহ

বিএনপির আজকের হরতালের ইস্যু দুটি: সব রকম জ্বালানি তেল, সিএনজির মূল্যবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন-নির্যাতন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে, বিশেষত, দেশটি যদি দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে হয়, সেখানে হরতাল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বিবেচিত হয়। অনেকে হরতাল নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব তুললেও বর্তমান শাসকদল সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও সেই প্রস্তাবে সায় দেয়নি। অর্থাৎ যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরাও বিরোধী দলে গেলে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে হরতালকে ব্যবহার করতে চান। সর্বশেষ হরতালের সময়ও সরকারি দলের কিছু নেতা বলেছিলেন, হরতাল হতে হবে যৌক্তিক। প্রকারান্তরে তাঁরা হরতাল পরিহারের কথা বলেননি।
হরতালের ব্যাপারে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতৈক্য রয়েছে। বর্তমান সরকারের সৌভাগ্যই বলব, এই সরকারের বর্তমান মেয়াদে এটি সপ্তম হরতাল। সুতরাং সংখ্যার দিক থেকেও মাত্রাতিরিক্ত কিছু হচ্ছে বলে বলা যাবে না। বিতর্ক হতে পারে ইস্যুর যৌক্তিকতা নিয়ে। এবারের হরতালের দুটি ইস্যুতেই জনমতের এবং জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়েছে। প্রথম আলোর ২১ সেপ্টেম্বরের প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম হলো ‘অর্থনীতি সামাল দিতে পারছে না সরকার’। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বলা যায়, হরতাল ডাকা যুক্তিযুক্ত হয়েছে। সরকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে আনাড়িপনার পরিচয় দিয়েছে, তাতে জনদুর্ভোগ ব্যাপকভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে ভর্তুকির চাপ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ভর্তুকির চাপ কমাতে জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। বাড়ার পরিমাণটাও নিতান্তই কম নয়। এমনিতেই মূল্যস্ফীতির জন্য জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে, বিশেষ করে নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার ডাবল ডিজিট। ডাবল ডিজিট মূল্যস্ফীতি একটি অর্থনীতির জন্য বিশাল হুমকি।
এই মূল্যস্ফীতির পেছনে কারণ অনেক। বড় কারণ হলো, সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে কুইক রেন্টাল পাওয়ার স্টেশন স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। এসব রেন্টাল পাওয়ার স্টেশনের কাছ থেকে চড়া মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে জনগণের কাছে সরবরাহ করতে হয়। এ ছাড়া সরকার বিদেশ থেকে বেশি দামে জ্বালানি তেল কিনে এসব পাওয়ার স্টেশনকে ভর্তুকিভিত্তিক বাজারমূল্যে সরবরাহ করে। সুতরাং এই ভর্তুকি হয়ে পড়েছে দ্বিস্তর ভর্তুকি। সরকারকে কৃষি এবং নিরাপত্তাব্যূহের জন্যও ভর্তুকি দিতে হয়। তাই বিশাল ভর্তুকির বোঝা বাজেটের ওপর চেপেছে। আমাদের দেশে বরাবরই ঘাটতি বাজেট পেশ করা হয়। এই ঘাটতি বাজেটের ঘাটতি আংশিকভাবে ব্যাংক-ব্যবস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এবং আংশিকভাবে বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া হয়।
বর্তমান অর্থবছরে বিদেশি সাহায্যের ধারাও স্তিমিত। পরিস্থিতিটা এমন, যা বিদেশি সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি হারে ডেব্ট সার্ভিসিং অর্থাৎ ঋণ পরিশোধের খরচ বহন করতে হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারের প্রতিক্রিয়াও দেশীয় বাজারের ওপর রয়েছে। খাদ্যসামগ্রীর মূল্য বেশি হওয়ায় সরকারকে শুধু গ্রামাঞ্চলেই নয়, শহরেও ভর্তুকিমূল্যে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে হচ্ছে। বিপুল ব্যাংকঋণ নেওয়ায় মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দারুণ ত্রুটি রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ কেন এই দায়ের বোঝা বহন করবে? জ্বালানির দাম বাড়ায় যাতায়াত, যোগাযোগ, ব্যবসার মালামাল পরিবহন—সব ক্ষেত্রেই খরচ বাড়বে। ব্যবসায়ীরা এই বাড়তি খরচ পণ্যমূল্যের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিপণন করবেন। তাঁরা নিশ্চয়ই লোকসান দিতে চাইবেন না, বরং লাভটা আরও বাড়িয়েই ধরবেন। এতে মূল্যস্ফীতি-পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠবে।
আমাদের দেশে যে গণতন্ত্র চালু আছে, তা ভোটের গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের যোগাযোগ বা বিরোধী দলের মতামতের কোনো মূল্য দেওয়ার সংস্কৃতি নেই। অথচ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূল কথা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠরাই শাসন করবে সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামত নিয়ে। প্রতিবেশী ভারতে অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মতামত গ্রহণের সংস্কৃতি চালু রয়েছে। তাই সেখানকার গণতন্ত্র বেশি টেকসই। বাংলাদেশে এ ধরনের সংস্কৃতি নেই বলে আমরা হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচির কথা শুনলে শঙ্কিত বোধ করি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি মনে হয় সংঘর্ষের পথে যাচ্ছে। অতীতে আমাদের সে রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরকারের ভারতনীতিই হোক, অর্থনীতিবিষয়ক নীতিমালাই হোক, কোনো ব্যাপারেই বিরোধী দলের মতামত গ্রহণ বা শোনার প্রয়োজন মনে করে না, বরং বিরোধী দলগুলোকে কীভাবে নাস্তানাবুদ করা যায়, সেদিকেই মনোযোগ বেশি। কথা উঠতে পারে, সংসদে বসেই তো এসব বিষয় আলোচিত হতে পারে। আমার পাল্টা প্রশ্ন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসার আগে অন্যান্য দলের সঙ্গে সংসদের বাইরেও আলোচনা করেছিলেন। আমাদের দেশে সেই সুদিন কবে আসবে? জনগণের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে প্রতিবাদ করা বিরোধী দলের দায়িত্ব। মওলানা ভাসানী আজীবন প্রতিবাদের রাজনীতি করেছেন। তিনি বলতেন, ‘আবেদন করব, নিবেদন করব, করজোড়ে মিনতি করব, তার পরেও যদি সরকার আমাদের কথা না শোনে, তাহলে চাবুক মেরে পিঠের চামড়া তুলে দেব।’ সাধারণ আবেদন-নিবেদন, কাকুতি-মিনতির ভাষা যখন কাজ করে না, তখন আমরা অপছন্দ করলেও রাজনীতিতে কঠিন প্রতিবাদের ভাষা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকটে সে দেশের জনগণকে আমরা প্রচণ্ড প্রতিবাদী হতে দেখেছি। যুক্তরাজ্যেও কয়েক সপ্তাহ আগে যে হিংসাত্মক ঘটনাগুলো ঘটল, তার গভীরেও রয়েছে জনগণের বঞ্চনার বোধ। সুতরাং নেতিবাচক রাজনৈতিক ঘটনাবলি পরিহার করার মূল দায়িত্বটি সরকারের। সরকারকেই নিজের ঘর সামলে অন্যদের সঙ্গে সংসদের মধ্যে হোক, সংসদের বাইরে হোক, কিংবা সরাসরি টেলিফোন করে হোক, আলাপ-আলোচনার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। সংসদেও সংসদীয় ভাষা ব্যবহার রপ্ত করতে হবে। যাতে কারও মনঃকষ্ট কিংবা অপমানিত বোধ করার কারণ না ঘটে। এ রকম পরিবেশেই আমরা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি।
রাতারাতি বিরাট পরিবর্তন আশা করা যাবে না। কিন্তু কোথাও না কোথাও শুরু করতে হবে। কাউকে না কাউকে শুরু করতে হবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সরকার ভারতের সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পাদন করেছে। এবং তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। কেন হলো না, কী জন্য হলো না, সেটাও আমরা ঠিকঠাক জানতে পারছি না। কিছুটা জানা যাচ্ছে ভারতীয় পত্রপত্রিকা থেকে। এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। সুতরাং স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসনের পথে অগ্রসর হয়েই অনেক রাজনৈতিক বিবাদ-বিসংবাদ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে, যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের জনদুর্ভোগের কথাও মনে রাখতে হয়। তা না হলে রাজনীতি নিরর্থক হয়ে যায়।
ড. মাহবুবউল্লাহ: অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.