চলতি পথে-মণি সিংহের স্মৃতিসৌধে

বেনু দেবনাথ। কোনো গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হওয়ার মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব নেই তাঁর। নেই তাঁর কাজে-কর্মে প্রখর প্রতিভার স্ফুরণ। অপরিসীম দারিদ্র্য ক্ষীণাঙ্গী এই নারীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত। এই দারিদ্র্যকে মেনে নিয়েছিলেন বেনু দেবনাথ; স্বামী-সন্তান নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী সমাজের সঙ্গে জীবন যাপন করেছিলেন হাসিমুখেই।


কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে আকস্মিকভাবেই স্বামীহারা হলেন তিনি। দুই সন্তান নিয়ে সমস্যার অকূল সাগরে নিপতিত হলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত এই প্রান্তিক নারী। নিকটাত্মীয়, স্বজন, বন্ধুরা কী করলেন তখন? অত্যন্ত রূঢ়ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। চিরকালের চেনা সমাজ অচেনা হয়ে উঠল মুহূর্তেই। প্রত্যাশিত সহযোগিতাবঞ্চিত বেনু দেবনাথ সমাজ পাল্টে ফেলার বিষয়ে মনস্থির করলেন এবার। দুর্গাপুরে খ্রিষ্টান মিশনারিদের কর্মপ্রক্রিয়ার বিষয়ে অস্পষ্টভাবে অবগত ছিলেন তিনি। দুই সন্তানসহ বেনু দেবনাথ ধর্মান্তরিত হলেন। কম্পিত হূদয়ে প্রবেশ করলেন নতুন এক সমাজের গণ্ডিতে। এবার নিশ্চয়ই বদলে গেল বেনু দেবনাথের অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক অবস্থান? না, বদলাল না কিছুই। কারণ, বেনু দেবনাথের মতো প্রান্তিক মানুষের জীবন এত সহজে বদলায় না। ধর্মান্তরিত হওয়ার মতো সহজ প্রক্রিয়ায় ঘটে না তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি। প্রান্তিক মানুষের সত্যিকার মুক্তি সম্ভব একতাবদ্ধ হওয়ার মহোৎসবে, জীবনের অর্থপূর্ণ পরিবর্তন সম্ভব সাংস্কৃতিক চর্চাসমৃদ্ধ সমাজ বিপ্লবে—হ্যাঁ, অনেকটা এভাবেই ভাবতেন বাম আদর্শে নিবেদিতপ্রাণ নেতা কমরেড মণি সিংহ। নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার উৎরাইল বাজারের শেষ প্রান্তে প্রায় ভেঙে পড়া এক ভাতের দোকানে শ্রমপ্রদানকারী নারীচরিত্র বেনু দেবনাথের জীবনকাহিনি শুনতে শুনতে মণি সিংহের কথা মনে হয় আমাদের।
বিখ্যাত সাম্যবাদী নেতা মণি সিংহের জন্ম নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলায় হলেও কৈশোরের দিনগুলো তাঁর অতিক্রান্ত হয় বেনু দেবনাথের জন্মস্থান দুর্গাপুরেই। মণি সিংহের পিতা কালীকুমার সিংহ ছিলেন পূর্বধলার জমিদার রাজা গোপীনাথ সিংহের উত্তরপুরুষ। কিন্তু পিতার অকালপ্রয়াণ বেনু দেবনাথের মতোই গভীর সংকটে নিমজ্জিত করে মণি সিংহের মা সরলা দেবীকেও। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, সরলা দেবীর অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক অবস্থান বেনু দেবনাথের মতো অপ্রতিভতায় আক্রান্ত ছিল না। সরলা দেবী ছিলেন সুসং জমিদার বংশীয়। সেই সূত্রে সাত বছর বয়সী মণি সিংহ ও তাঁর অন্য ভাইবোনদের নিয়ে সরলা দেবী চলে আসেন সুসং দুর্গাপুরে। সুসং জমিদারদের দেওয়া বসতবাড়ি, কৃষিজমি, বার্ষিক খোরাকি এবং শরিক হিসেবে ধার্য করা মাসোহারায় চলতে থাকে মণি সিংহদের সংসার।
মণি সিংহের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় দুর্গাপুরে। মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য মণি সিংহের মা তাঁকে কলকাতায় পাঠান। কিন্তু অধ্যয়নরত অবস্থাতেই মণি সিংহ জড়িয়ে পড়েন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের অন্তিম-পাদে মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিলেন তিনি। যোগদান করলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে মেটিয়া বুরুজে কেশোরাম কটন মিলে শ্রমিকদের ১৩ দিনের ধর্মঘটে সফল নেতৃত্ব দিলেন মণি সিংহ। এরপর অন্যান্য আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও কুশলতার পরিচয় দিলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই মণি সিংহের কর্মকাণ্ডের ওপর অসহিষ্ণু দৃষ্টি পড়ল ব্রিটিশ সরকারের। চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের অজুহাত সৃষ্টি হলো শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে। ১৯৩০ সালের ৯ মে গ্রেপ্তার হলেন মণি সিংহ। ১৯৩৫ সালে সুসং দুর্গাপুরের নিজ বাড়িতে অন্তরীণ করা হলো তাঁকে।
অন্তরীণ থাকাকালে মণি সিংহ সুসং পরগনায় টংক প্রথায় জর্জরিত কৃষককুলের প্রতি মনোযোগী হলেন। ‘টংক’ শব্দটি দেশজ। স্থানীয় এই শব্দটির অর্থ ধান কড়ারি খাজনা। অর্থাৎ জমিতে ধান হোক কিংবা না-ই হোক, সুসং পরগনায় সোয়া এক একর জমির জন্য বছরে সাত থেকে পনেরো মণ ধান খাজনা হিসেবে জমিদারকে দিতেই হবে কৃষকদের। মণি সিংহদের পরিবারেরও টংকের জমি ছিল। তা সত্ত্বেও মণি সিংহ কৃষকদের সংগঠিত করে শুরু করলেন টংক আন্দোলন। অনন্য এই আন্দোলনের সফলতা মণি সিংহকে প্রতিষ্ঠা করল প্রান্তিক মানুষের অবিসংবাদিত নেতার চিরঅম্লান আসনে।
মণি সিংহের কথা ভাবতে ভাবতে বেনু দেবনাথের কাছ থেকে বিদায় নিলাম আমরা। ভাতের দোকানের সামনে থেকে রিকশা নিয়ে পৌঁছালাম দুর্গাপুর সদরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মহারাজা কুমুদচন্দ্র মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের সন্নিকটে। বিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে তাঁতিখালী খাল। দক্ষিণে মাঠ এবং সেই মাঠের পশ্চিম প্রান্তে একটি নান্দনিক স্মৃতিসৌধ দণ্ডায়মান। হ্যাঁ, কমরেড মণি সিংহ স্মৃতিসৌধ এটি।
প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কারিগরি নকশায় এবং শিল্পী রবিউল হুসাইনের স্থাপত্য ভাবনায় নির্মিত এই নান্দনিক সৌধটি মূলত একটি অর্ধবৃত্তাকার অনুচ্চ বেদির ওপর স্থাপিত দুটি সিমেন্টে বাঁধানো পরস্পর-সংযোগী আয়তক্ষেত্রের সুষম সমন্বয়। ঊর্ধ্বমুখী আয়তক্ষেত্র দুটির মধ্যবর্তী অংশে পাঁচটি করে পরস্পর-সংযোগী বৃত্তের অবস্থান। আয়তাকার এই সংযোগ, বৃত্তাকার এই সংযোগ অবশ্যই কোনো সাধারণ সংযোগ নয়। প্রতীকী অর্থে এই সংযোগ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে উৎসর্গীকৃত প্রাণের অন্তরের সংযোগ, এই সংযোগ বিপ্লবমুখর প্রান্তিক মানুষের হূদয়ের সংযোগ।
দীপংকর চন্দ

No comments

Powered by Blogger.