বসবাসের অনুপযোগী শহর-ঢাকার এই দুর্নাম ঘোচানোর দায়িত্ব কার? by এ কে এম জাকারিয়া

আন্তর্জাতিক কোনো জরিপ, সূচক বা প্রতিবেদন প্রকাশ মানেই যেন বাংলাদেশের তরফ থেকে প্রতিবাদ, প্রতিবেদন বা সূচক প্রত্যাখ্যান। তা অ্যামনেস্টির মানবাধিকার-সংক্রান্ত রিপোর্ট, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা টিআইয়ের দুর্নীতির ধারণা সূচক—যা-ই হোক না কেন।


বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিষয়ে সরকারের ‘প্রত্যাখ্যান’ করার মতো একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। প্রতি ছয় মাস পর পরই এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি দুনিয়ার কোন শহর সবচেয়ে বসবাসের উপযোগী, তার একটি তালিকা করে। বসবাসের সবচেয়ে উপযোগী শহরগুলোর ধারাবাহিক তালিকা করতে গিয়ে পর্যায়ক্রমে নিচের দিকে নামে তারা। ফলে বসবাসের দিক দিয়ে কোন শহরগুলো সবচেয়ে খারাপ, সেটাও পাওয়া যায়। এ মাসের শুরুর দিকে ১৪০টি শহরের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে তারা। বসবাসের সবচেয়ে অনুপযোগী হিসেবে সবশেষ অর্থাৎ ১৪০তম শহর হচ্ছে জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ১৩৯। বসবাসের সবচেয়ে অনুপযোগী শহরের খেতাব পাওয়া থেকে অল্পের জন্য বঞ্চিত (?) হলাম আমরা!
ছয় মাস আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এর আগের তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানেও হারারে ও ঢাকার অবস্থান একই ছিল। নিচের দিকে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে আগের তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের উপযোগী শহর হিসেবে স্থান পাওয়া কানাডার ভ্যানকুভার এবার নেমে গেছে ৩ নম্বরে। টানা পাঁচ বছর ধরে শীর্ষ স্থানটি ধরে রেখেছিল কানাডার এই শহর। এবার ১ নম্বরে উঠে এসেছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। গত তালিকায় তাদের অবস্থান ছিল ৩ নম্বরে। ভ্যানকুভার চলে গেছে ৩ নম্বরে। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা আগের মতোই দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে। তালিকায় এভাবে ওঠানামা হয়। কারণ, আরও বাসযোগ্য করে তুলতে শহরগুলো নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়। কোনো কোনো শহর পিছিয়ে পড়ে। বিষয়টি অনেকটা প্রতিযোগিতার মতো।
ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের যারা এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তাঁরা তালিকার শীর্ষে থাকা শহরগুলো সম্পর্কে লিখেছেন, ‘যে শহরগুলো সবচেয়ে ভালো করেছে, সেগুলো ধনী দেশগুলোর কম জনসংখ্যার মাঝারি আকারের শহর। এর ফলে বড় কোনো মাত্রার অপরাধ এবং মাত্রাহীন অবকাঠামো ছাড়াই এ শহরগুলো বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারছে।’ ওপরের দিকের এই তালিকা নিয়ে আলোচনা থাক। কারণ, আমাদের যা বাস্তবতা, তাতে এসব অর্থহীন বলেই মনে হবে। আমরা বরং তালিকার নিচের দিকে থাকা শহরগুলোর দিকে তাকাই।
কেন হারারে সবচেয়ে খারাপ? সর্বত্র ছিঁচকে অপরাধ, সামাজিক অস্থিরতা ও সংঘাতের হুমকি এবং দেশটির গণপরিবহনের অবস্থা—এগুলোই এই শহরটিকে বসবাসের সবচেয়ে অনুপযোগী করার জন্য দায়ী। গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য হচ্ছে, ‘সেখানকার গণপরিবহনের যা অবস্থা, সেটাই হারারে শহরটিকে তালিকার সবচেয়ে নিচে রাখার জন্য যথেষ্ট।’ আমাদের ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র জিম্বাবুয়ে গিয়েছেন এ পর্যন্ত চারবার—প্রতিবারই একটা সময় হারারে থেকেছেন। ভালো মানের হোটেলে থেকে আর ক্রিকেট কাভার করতে গিয়ে একটি শহরের কতটুকুই আর চেনা যায়! ঢাকা আর হারারের মধ্যে যদি তুলনা করতে বলি? ‘ঢাকার মতো লোকজনের ভিড় নেই, নেই এখানকার মতো ট্রাফিক জ্যামও। বড় পার্থক্যটি এখানেই।’ পরিবহনব্যবস্থা? ‘শহরটিতে বড় কোনো বাস চোখে পড়েনি। ভাড়া বেশি হলেও ট্যাক্সি পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে শহরটিতে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে কখনো ইনসিকিউরিটির ফিলিংস হয়নি।’ এর পরও কেন হারারে সবচেয়ে বসবাসের অনুপযোগী শহর? জিম্বাবুয়ের ব্যাপারে পশ্চিমাদের একটি বিদ্বেষ রয়েছে—শুভ্রর ব্যাখ্যা অনেকটা এ রকম।
হারারে ও ঢাকার চেয়ে যে শহরগুলোর অবস্থা ভালো, এমন কয়েকটি শহর হচ্ছে—পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোর্সবে, নাইজেরিয়ার লাগোস, আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, লিবিয়ার ত্রিপোলি ও পাকিস্তানের করাচি। ত্রিপোলি ও করাচি—এই দুটি শহরও ঢাকার চেয়ে বসবাসের উপযোগী? আগেই বলেছি, গত তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে প্রকাশিত নতুন তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে এর পরের তথ্য বিবেচনায় নিয়ে। লিবিয়ায় ন্যাটোর বিমান হামলা শুরু হয় মার্চের মাঝামাঝি। এরপর থেকে আগস্টে বিদ্রোহীরা ত্রিপোলিতে ঢোকার আগে শহরটি ছিল কার্যত অবরুদ্ধ। আমাদের যে শ্রমিকেরা কাজ করতেন শহরটিতে, তাঁরাও এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এখন ত্রিপোলি শহরটির কী অবস্থা, তা নিয়মিত যাঁরা পত্রপত্রিকা পড়েন ও টিভি দেখেন, তাঁদের অজানা থাকার কথা নয়। শেষ দশের তালিকায় সে কারণেই চলে এসেছে ত্রিপোলি। কিন্তু এর পরও ঢাকার চেয়ে ওপরে। আর পাকিস্তানের করাচি শহরে জুলাই মাসের শুরুর দিকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে তিন দিনের সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে ৩৯ জন। পাকিস্তানের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম ছয় মাসে রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে এক হাজার ১০০ লোক। (সূত্র: বিবিসি)। এর পরও ঢাকা কেন পিছিয়ে?
পাঁচটি ক্ষেত্রের প্রায় ৩০টি দিক বিবেচনায় নিয়ে এই তালিকা তৈরি করে থাকে ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো—এগুলো হচ্ছে বিবেচনার মূল বিষয়। স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় ছোট ও বড় অপরাধ পরিস্থিতি, সহিংস অপরাধের মাত্রা, সন্ত্রাসের হুমকি, সামরিক যুদ্ধের হুমকি, গৃহযুদ্ধের হুমকি। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে দেখা হয় ব্যক্তিগতভাবে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সক্ষমতা, সরকারি ও বেসরকারি সক্ষমতা ও স্বাস্থ্যসেবার সাধারণ মান। সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত বিবেচনার মধ্যে রয়েছে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কোন পর্যায়ের, ভ্রমণকারীদের জন্য আবহাওয়াটা কতটুকু আরামদায়ক, দুর্নীতির মাত্রা, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ, সেন্সরশিপের মাত্রা, ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবস্থান, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি, খাদ্য-পানীয়-ভোগ্যপণ্যের মান ও সেবা-পরিস্থিতি। শিক্ষার মধ্যে বিবেচনায় নেওয়া হয় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষার সক্ষমতা, সার্বিক শিক্ষার মান। অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে সড়ক যোগাযোগের মান, গণপরিবহন-ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, মানসম্মত বাসা ভাড়া পাওয়ার নিশ্চয়তা, জ্বালানি-পরিস্থিতি, পানি সরবরাহের মান ও টেলিযোগাযোগের মান।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রথম যে বিবেচনা অর্থাৎ স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা ভালোই বলতে হবে। সমস্যাটি তাহলে বাকিগুলোতে। আমাদের দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে না, তার পরও যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত, ঢাকায় কোনো সামরিক যুদ্ধের হুমকি নেই, কিন্তু ৩০ মিনিটের পথ যেতে তিন ঘণ্টার বেশি লাগতে পারে, কার্যকর গণপরিবহন বলতে যা বোঝায়, তা ঢাকায় নেই। আপনি বাসে উঠতে পারবেন না, আবার বেশি পয়সা খরচ করে যে সিএনজি স্কুটার পাবেন, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। পেলেও মিটারে যাবে না। চাইলে ট্যাক্সিক্যাব পাওয়া যায় না—ঢাকা ছাড়া এমন কোনো রাজধানী শহর আছে বলে মনে হয় না। ঢাকা এমন একটি শহর, যেখানে পথচারীদের চলাচলের জন্য সামান্যতম যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত, তা-ও নেই। এখানে রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক বা গোষ্ঠীগত সহিংসতায় তিন দিনে ৩৯ জনের মৃত্যুর রেকর্ড নেই, কিন্তু এখানে আছে পদে পদে দুর্নীতি। এখানে করাচির মতো সন্ত্রাসের হুমকি নেই, কিন্তু বিদ্যুৎ পাবেন এমন নিশ্চয়তা নেই—এক ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে শহর অচল হয়ে পড়বে। বড় ধরনের ‘সহিংস অপরাধের উপস্থিতি, সন্ত্রাসের হুমকি, সামরিক যুদ্ধের হুমকি ও গৃহযুদ্ধের হুমকি’ ছাড়াও আমাদের ঢাকা কেন পিছিয়ে পড়ল, তা আমরা অনুমান করতে পারছি।
সর্বশেষ এই তালিকায় যে সময়ের ঢাকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, তখন এখানে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন চলছিল। সে সময় মিরপুর স্টেডিয়ামে দুটি খেলা দেখে গাড়ির পার্কিং পর্যন্ত আসতে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তখনই মনে হয়েছিল, কোনো সাধারণ ক্রিকেট পর্যটক যদি শুধু খেলা দেখার জন্য ঢাকায় এসে থাকেন, সে বেচারার দশাটি কী! তিনি যদি সাধারণ মানের কোনো হোটেলে উঠে থাকেন, তবে খেলা দেখে হোটেলে ফিরবেন কীভাবে? বাসে বা ট্যাক্সিক্যাবে? বাসে ওঠার কোনো অবস্থা নেই, ট্যাক্সিক্যাব বলেও এখন ঢাকায় কিছু নেই। সিএনসি স্কুটার দুর্লভ। পুরো দিনের জন্য রেন্ট-এ-কার নেওয়া ছাড়া একজন ক্রিকেট পর্যটকের মিরপুর স্টেডিয়ামে খেলা দেখে হোটেলে ফেরার কি আর কোনো উপায় ছিল? একজন সাধারণ ক্রিকেট পর্যটকের পক্ষে কি এই বিলাসিতা সম্ভব?
ইআইইউ এই তালিকাটি করে মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কথা মাথায় রেখে। এর ওপর ভিত্তি করে কোন শহরে তাদের একজন কর্মীকে পাঠালে কী পরিমাণ ‘হার্ডশিপ ভাতা’ (কষ্টকর পরিস্থিতিতে কাজ করার ভাতা) দিতে হবে, তা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। বর্তমান তালিকা অনুযায়ী এখন যদি কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের কোনো কর্মীকে হারারে শহরে পোস্টিং দিতে চায়, তবে তাকে নির্ধারিত বেতনের বাইরে সবচেয়ে বেশি হার্ডশিপ ভাতা দিতে হবে। মানে এই শহরে থেকে তিনি যে ‘শাস্তি’ ভোগ করবেন, তা পুষিয়ে দেওয়া হবে অতিরিক্ত ভাতা দিয়ে। এর পরই সবচেয়ে বেশি ‘হার্ডশিপ’ ভাতা দিতে হবে ঢাকায় থাকার বিড়ম্বনা ভোগ করার খেসারত হিসেবে।
কাজের সূত্রে ঢাকায় থাকেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে গত কয়েক দিনে। ঢাকায় থাকার মূল কষ্টটি কী? প্রায় সবাই দুষলেন ঢাকার পরিবহনব্যবস্থাকে। ‘নিজের গাড়ি না থাকলে একজন বিদেশির পক্ষে ঢাকায় চলাচল প্রায় অসম্ভব, আর হেঁটে চলব, তারও কোনো উপায় নেই’—জানালেন একজন। আরও বড় একটি অনুযোগ হচ্ছে, কাজের পর সন্ধ্যায় সময় কাটানোর কোনো ব্যবস্থা নেই এই শহরটিতে। একটি কার্যকর গণপরিবহনব্যবস্থা যে আমাদের প্রিয় ঢাকার কপাল থেকে বসবাসের অনুপযোগী দ্বিতীয় শহরের কলঙ্ক দূর করতে পারে—সে ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিত হলাম।
বাসে ওঠার সুযোগ, ট্যাক্সি পাওয়ার সুযোগ, হাঁটার সুযোগ—ঢাকায় এই সুযোগ নিশ্চিত হবে কবে? খুব আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। কারণ, প্রতি ছয় মাস পর পর এই যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, তা সরকারের তরফে কেউ বিবেচনায় নেয় বলে মনে হয় না। ২০০৯ সাল থেকে ঢাকা একই কলঙ্ক বয়ে বেড়ালেও এই তালিকা ‘প্রত্যাখ্যান’ করার মতো গুরুত্ব দেয়নি সরকারের কেউ। টিআইয়ের রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করতে করতে বাংলাদেশ এখন দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের শীর্ষ স্থান থেকে নিচে নেমেছে। ইআইইউয়ের এই তালিকা যদি আমাদের সরকারের তরফ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হতো, বলা হতো ‘ভিত্তিহীন’—তবে আশা করতে পারতাম যে সামনে ঢাকা একটু একটু করে বসবাসের আরও উপযোগী হয়ে উঠবে। ঢাকার এই দুর্নাম ঘোচানোর দায়িত্ব আসলে কার?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.