বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। শিক্ষার প্রাথমিক ভিত হিসেবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত শিক্ষক সমাজের আর্থিক উন্নতিসহ জাতীয় উন্নয়নে এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করে। প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা দিন দিন উন্নতির দিকে যেতে থাকে।
পরবর্তীকালে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বেসরকারিকরণের চেষ্টা করা হয়। শিক্ষকদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। বেশ কয়েক মাস শিক্ষকদের দারুণ কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছিল। আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। আমি ছোট ছিলাম, কিন্তু পরিবারের কষ্টের কথা এখনো ভুলতে পারি না।
বর্তমানে আমাদের দেশে দুই ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে_সরকারি এবং রেজিস্টার্ড বেসরকারি (কমিউনিটি বিদ্যালয়গুলোকে রেজিস্টার্ড বেসরকারি বিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়) প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারি বেতন-ভাতা পান; কিন্তু বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁদের চেয়ে অনেক কম বেতন পান, যদিও শুরুতে তাঁদের বেতন-ভাতাও সামান্যই ছিল। তবু বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে তাঁদের বেতন-ভাতার রয়েছে ব্যাপক ফারাক। দুই ধরনের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও রয়েছে পার্থক্য। সুতরাং শিক্ষকদের মানের মধ্যেও ব্যবধান থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এর অর্থ এই নয়, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মেধাবী নন। চাকরি অপ্রতুল হওয়ায় বহু মেধাবী ছেলেমেয়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি নেয়।
দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ভিত যত মজবুত এবং সুদৃঢ় হবে, শিক্ষার গুণগত মান ততই উন্নত হবে। এ দিকটি আমাদের দেশের সরকারকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। সরকার একেবারেই যে বোঝে না, তা কিন্তু নয়। বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষাসহ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর বেতন বৈষম্য দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কুরে কুরে খাচ্ছে। বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষাঘণ্টা, ক্লাস সংখ্যা, সরকারি কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধান কোনো অংশেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে কম নয়। কিন্তু রয়েছে বিস্তর বেতন বৈষম্য। আর্থিক বিচারে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান নিচু হওয়ায় সমাজের অপরাপর পেশাজীবী মানুষও তাদের ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। আর আর্থিক অবস্থার সঙ্গে মানসিক সুখ-শান্তির সম্পর্ক থাকায় মনোযোগ সহকারে বিদ্যালয়ে পাঠদান করাতেও পারেন না তাঁরা। ফলে গুণগত শিক্ষার কথা বাদই দিলাম, শিক্ষার হার বাড়ানোর ক্ষেত্রেও গলদ রয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। নইলে লক্ষ্যে পেঁৗছা সম্ভব হবে কি? আমরা জানি, বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে শিক্ষক সংকট। এই সংকট শিক্ষার অন্যান্য স্তরেও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কমবেশি উদ্যোগও বিদ্যমান। যেমন, সরকার প্রতিবছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ করছে। আমরা এই উদ্যোগকে সাদুবাদ জানাই। কিন্তু বছরের পর বছর অবহেলায় থাকা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে সরকারের ভাবনা কী? তারা কি সত্যিকারভাবেই এর উন্নয়ন চায়? স্বীকার করছি, শিক্ষা উপকরণসহ অন্যান্য উপকরণ সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো বৈষম্য নেই। কিন্তু যারা এসব উপকরণ ব্যবহার করবেন, তাঁদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা কি জরুরি নয়?
সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ের বেতন বৈষম্য দূর করার জন্য বিগত সরকারগুলো কিছু কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তাতে শিক্ষকরা বেশি লাভবান হচ্ছেন না। প্রতি পাঁচ বছর পর নতুন সরকার এমনি কি নির্বাচনী ইশতেহারে বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কল্যাণে মহাপরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন? কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা অনেকটা ভুলে যান। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়। প্রকল্পের নামে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ, নামি-দামি গাড়ি ক্রয় ও ব্যবহার এবং প্রশিক্ষণের নামে কোটি কোটি খরচ করা হয়। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের একটি বড় পন্থা যে শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ, তা আমাদের কর্তাব্যক্তিরা ভুলে যান। আর ভুলে যান বিধায় শিক্ষকদের আন্দোলনের জন্য মাঠে নামতে হয়। তবুও শিক্ষকরা আশার বুক বাঁধেন_হয়তো একদিন তাঁদের চাকরি জাতীয়করণ করা হবে।
আমি অর্থনীতি কিংবা হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র নই। কিন্তু এ কথা বলতে পারি, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা খুব কঠিন নয়। সরকার প্রতিবছর বাজেটে বিভিন্ন খাতে যে বরাদ্দ দেয়, তার পুরোটা খরচও করতে পারে না। গত দুই বছরে পিপিপি খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সরকার তার সিকি ভাগ খরচ করতে সক্ষম হয়েছে। অথচ একই সময়ে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিদারুণ আর্থিক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যার প্রথম সাফল্য একটি সুন্দর শিক্ষানীতি। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিভিন্ন সময় শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার কথা বলে আসছেন। আমরা চাই তাঁদের কথার সঠিক বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছি এবং সফলতার মুখ দেখছি। বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থায় নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করতে পারেন, তাহলে তাঁর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন পারবেন না সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করতে। আমরা তাঁর কাছে জোরালো দাবি জানাচ্ছি, তিনি যেন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন, হাজার হাজার শিক্ষক এবং তাদের পরিবারের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে সহায়তা করেন। জাতি তাঁকে এ জন্য শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.