নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-কাফকোর ঘটনা ও সাংসদের সম্মান by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

একজন সাংসদের অনুরোধে স্থানীয় কিছু লোকজনকে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ‘কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি’ (কাফকো)। প্রশ্ন উঠতে পারে, যথাযথ নিয়োগ-প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে এই অনুরোধে ঢেঁকি গেলা কতটা যুক্তিযুক্ত। সেই প্রশ্নে যাব না।


কারণ, কোনো এলাকায় একটি বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে স্থানীয় ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের একটা দাবি থাকতেই পারে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকার সাংসদ আখতারুজ্জামান চৌধুরীর অনুরোধের মধ্যেও তাই নিয়মের ব্যত্যয় খুঁজতে যাই না। কিন্তু অনুরোধ রক্ষা করেও যখন লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচতে পারেন না কর্মকর্তারা, তখন তাঁদের ক্ষোভ-দুঃখ-হতাশার ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারি। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়েও চিন্তিত না হয়ে উপায় নেই।
কাফকোর কর্মকর্তারা কেন লাঞ্ছিত হয়েছেন, তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল আনোয়ারা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান চৌধুরীর কাছ থেকে। তিনি বলেছেন ‘সাংসদ আখতারুজ্জামান চৌধুরীর অনুরোধে চারজনকে চাকরি দেওয়া হয়েছে কাফকোতে। কিন্তু তাঁদের নিরাপত্তাকর্মীর পদে এবং শিল্পমন্ত্রীর সুপারিশের লোকজনকে কর্মকর্তা পদে চাকরি দেওয়া হয়েছে। এটা করে তাঁরা সাংসদকে অপমান করেছেন। এলাকার মানুষ তা মেনে নেবে না’ (প্রথম আলো, ১৩ সেপ্টেম্বর)। তার মানে শুধু চাকরি দেওয়াই যথেষ্ট নয়, সাংসদের সম্মান রক্ষা করতে হলে যোগ্যতার প্রশ্ন না তুলে তাঁদের পছন্দসই পদেই নিয়োগ দিতে হবে। কাফকোর কর্মকর্তারা সাংসদের সম্মান রক্ষা করতে পারেননি বলে তাঁদের নিজেদেরও অসম্মানিত হতে হয়েছে প্রকাশ্যে! তাঁদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি পুলিশ, বরং মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে যখন কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করা হয়, তখন আহত হয়েছেন তাঁদের সঙ্গে থাকা পুলিশের সদস্যরাও।
কাফকোর কর্মকর্তাদের ওপর হামলার ঘটনা এটিই প্রথম নয়, একই কারণে আরও কয়েক দিন আগে এক দফা হামলার শিকার হয়েছিলেন চার কর্মকর্তা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হলো না কেন? বরং তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ কমিশনার (বন্দর) মো. শাহরিয়ার আলী বলেছেন, ‘কাফকো এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। পরিস্থিতি এখন আমাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে।’ অপরাধী সময়মতো অপরাধ সংঘটন করে চলে যাওয়ার পর পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সে প্রশ্ন কে করবে তাঁকে? তিনি জানিয়েছেন, এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। কে করবে মামলা? আগেরবার মামলা করার খেসারত যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা কি আর সেই বেলতলায় যাবেন? কাফকোর কর্মকর্তা জাওয়াদুল হক যথার্থ সেই উপলব্ধিটাই তো প্রকাশ করেছেন সাংবাদিকদের কাছে, ‘আমরা বোধ হয় মামলা করেই ফেঁসে গেছি। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি, তাঁরাই আমাদের ওপর হামলা করেছে।’
এর আগে এ ঘটনার একটি মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। তিনি নিজেও সুপারিশ করে লোক নিয়োগ দিয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানে। ফলে কিছু দায় তো তাঁরও আছে। আগেই বলেছি, বেকারত্ব যেখানে বিরাট অভিশাপ, সেখানে কর্মসংস্থানের সুপারিশ করলে খুব বেশি কিছু বলার থাকে না। শুধু যাঁদের দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, অথচ মন্ত্রী বা সাংসদের কাছে ধরনা দেওয়ার সুযোগ বা যোগ্যতা নেই, তাঁদের হা-হুতাশটা এতে বাড়ে। যা-ই হোক, কাফকোর ঘটনা নিয়ে অসন্তোষ নিরসনে সেখানে একটি কর্মসূচি দিয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরোধিতার মুখে শেষ পর্যন্ত কর্মসূচি বাতিল করতে বাধ্য হন। অর্থাৎ দিলীপ বড়ুয়া মহাজোট সরকারের মন্ত্রী বটে, কিন্তু সরকারদলীয় স্থানীয় নেতা-সমর্থকদের কাছে অপাঙেক্তয়।
কাফকোর ঘটনার আপাতত নিষ্পত্তি হয়েছে। আখতারুজ্জামান চৌধুরীর সমর্থকদের দাবি অনুযায়ী চারজন কর্মীকে পছন্দমতো পদে (উৎপাদন বিভাগ) নিয়োগ দিয়েছে কাফকো কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবিতেই প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ক্যাপ্টেন ইকবালকে পাঠানো হয়েছে ছুটিতে। অর্থাৎ আখতারুজ্জামান চৌধুরীর সম্মান অক্ষুণ্ন (?) থাকল। কিন্তু এর ফলে একটি বহুজাতিক কোম্পানির প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হলো কি না, কিংবা এই ঘটনা থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নেতিবাচক কোনো বার্তা পেল কি না—এসব নিয়ে ভাববার অবকাশ হয়তো আজ সাংসদ বা সরকার কারোরই নেই।
যাঁর সম্মান রক্ষার জন্য কর্মীরা এমন বেপরোয়া, সেই আখতারুজ্জামান চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন অনেক উত্থান-পতনময়। চট্টগ্রামের এই প্রবীণ রাজনীতিক একসময় দলের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এই শিল্পপতি-রাজনীতিক ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর অজ্ঞাত কোনো এক অভিযোগে দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ ও দলের নানা পট-পরিবর্তনের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নিলে পুনরায় আওয়ামী লীগে জায়গা করে নেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কমিটির শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এর মধ্যে হুমায়ুন জহির হত্যা মামলায় জড়িয়ে এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (তিনি এ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকদের একজন) বোর্ড মিটিংয়ে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত হয়ে দলের কেন্দ্রীয় পদ থেকে অপসারিত হন। এসব ঘটনায় আখতারুজ্জামানের ভাবমূর্তি ও রাজনৈতিক জীবনও কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ে। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন বিএনপির প্রার্থী সরওয়ার জামাল নিজামের কাছে। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন তাঁর ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবন ছিল প্রায় দুর্বিষহ। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা যেমন নেই, তেমনি রাজনীতিকের উত্থান-পতনময় জীবনেরও শেষ কোথায়, তা নিশ্চিত করে জানিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। সেই নিয়মে আবার সুসময়ের সন্ধান পান আখতারুজ্জামান চৌধুরী।
২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হন তিনি। আনোয়ারা থানা বিএনপির নেতা জামালউদ্দিন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দলীয় সাংসদ সরওয়ার জামাল নিজামের নাম জড়িয়ে পড়লে তাঁর নির্বাচিত হওয়ার পথ সুগম হয়। অন্যদিকে হুমায়ুন জহির হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি লাভ ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে পুনরায় আসীন হয়ে আখতারুজ্জামান নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন, দুর্দিনকে পেছনে ফেলে এসেছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই আশা করা গিয়েছিল, পোড় খাওয়া এই রাজনীতিক তাঁর সুসময়কে জনকল্যাণের কাজে লাগাবেন।
কিন্তু কাফকোর ঘটনা ও অন্যান্য কিছু কর্মকাণ্ড আমাদের আশাহত করেছে। সমর্থকেরা তাঁর সম্মান রক্ষার জন্য যেসব তৎপরতা চালাচ্ছেন, তা তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য আদৌ শুভ কি না, এখনই তা ভাবতে হবে। ইতিমধ্যে এলাকায় পৌর নির্বাচনে তাঁর সমর্থিত অধিকাংশ চেয়ারম্যান প্রার্থীর পরাজয়কে অশনিসংকেত হিসেবে তিনি গ্রহণ করবেন কি না জানি না। না করলে তার খেসারত দিতে হবে—ঘটনাবহুল জীবন ও রাজনীতির অভিজ্ঞতায় এ কথা তাঁর চেয়ে ভালো আর কে বুঝবেন!
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.