নির্বাচন-দুই বড় দলের বড় ভুল by শেখ হাফিজুর রহমান

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছে। তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিরোধী দল রাজপথে জোরদার আন্দোলন শুরু করেছে। সরকারের বাকি সময়টা মসৃণ হবে না। বিরোধী দলের আন্দোলন সামাল দিতেই সরকারকে অনেকটা সময় ও রাজনৈতিক শক্তি ব্যয় করতে হবে।


আর রাজনীতির এ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়বে বৃহত্তর সামাজিক পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা, আইনশৃঙ্খলা ও শিক্ষার ওপর এর অভিঘাত হবে খুবই নেতিবাচক। এ রকম অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কয়েকটি বার্তা দিয়ে গেল। বার্তার ভাষাগুলো রাজনীতির নীতিনির্ধারকেরা পড়বেন, তার মর্মার্থ অনুধাবন করে সে অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করবেন বলে আশা করতে চাই। কিন্তু রাজনীতিবিদদের কাণ্ডকারখানা দেখে প্রায়ই সন্দিহান হয়ে পড়ি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নিয়ে যে কটি পক্ষের তৎপরতা আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে এবং সারা দেশের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, পক্ষগুলো হচ্ছে সরকার, বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ।

দুই
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে সেলিনা হায়াৎ আইভী বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ায় ৩০ অক্টোবর রাতেই তাঁকে অভিনন্দন জানান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। প্রথম আলোকে সৈয়দ আশরাফ যে কথাগুলো বলেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, এ নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের তিনটি লক্ষ্য ছিল—এক. নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করা। দুই. সেনাবাহিনী মোতায়েন ছাড়াই যাতে জনগণ নির্ভয়ে ও অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করা। তিন. ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার করে ভোট নেওয়া। সৈয়দ আশরাফ যেমনটি বলেছেন, আমিও তেমনই মনে করি যে সরকার ওপরে উল্লিখিত তিনটি লক্ষ্যই সফলভাবে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও সরকার দুটি জায়গায় অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে বলে । প্রথমটি হচ্ছে, দলীয়ভাবে শামীম ওসমানের মতো একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে সমর্থন প্রদান। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের অনুরোধ সত্ত্বেও সেনা মোতায়েন না করা । এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সরকারের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যন্ত এনেছেন। সরকার যদি মনে করে থাকে যে নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কোনো প্রয়োজন নেই, তাহলে আমি সরকারকে সাধুবাদ দেব। কেননা বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশের দুজন রাষ্ট্রপতিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন। সেনাবাহিনী অবৈধভাবে একাধিকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে। উপরন্তু, রাজনীতিকে কলুষিত ও বিপথগামী করার ব্যাপারে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দায়ও কম নয়। এমন পরিস্থিতিতে কোনো সরকার যদি সেনাবাহিনী মোতায়েন না করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাকে আমি পরিপক্ব ও প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত বলব। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে গোপনীয়তার নীতি অনুসরণ করে পরিপক্বতার পরিচয় দেয়নি।

তিন
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শেয়ারবাজারের ধস মিলিয়ে মানুষের মধ্যে যখন এক ধরনের অস্থিরতা চলছিল তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিরোধী দল বিএনপির সাম্প্রতিক আন্দোলনে মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ করা গেছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যে ভুল করেছে, ওই একই ভুল করেছে বিএনপি। কেননা তৈমুর আলম খন্দকারের মতো একজন বিতর্কিত লোককে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। দ্বিতীয় ভুলটি বিএনপি করেছে ভোট গ্রহণ শুরুর সাত ঘণ্টা আগে মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলন করে তৈমুর আলম খন্দকারের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে। বিএনপির ইভিএমের ব্যাপারে আপত্তি ছিল এবং তারা সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছিল। ২৯ অক্টোবর রাত পৌনে একটায় গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক আকস্মিক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না—আমরা এ প্রহসনের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছি।’ বিএনপি যদি শুরু থেকেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করত, তাহলে সেটি গ্রহণযোগ্য হতো।

চার
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যম একটি শক্তিশালী ও ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল। শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘প্রতিষ্ঠান’ হয়ে ওঠা দরকার তার কোনোটাই আমাদের নেই। আমাদের এখানে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। নির্বাচন কমিশন পুরো স্বাধীন নয়, দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর নেই। আমাদের বিচার বিভাগ সব সময় গণতন্ত্র ও সাংবিধানিকতার সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে না। এ অবস্থায় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম যে ভূমিকা পালন করেছে তা সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ওপর প্রথম থেকেই সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। গণমাধ্যমের নজরদারি এড়িয়ে কারও পক্ষে নির্বাচন বানচাল বা নির্বাচনে কারচুপি করাটা খুব কঠিন হতো। এ জন্য গণমাধ্যম সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
পাদটীকা: নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল সবার জন্য একটি বার্তা দিয়ে গেল: জনতার শক্তিই আসল শক্তি। জনগণ অবাক হয়ে দেখেছে কীভাবে দল ও নেতা-নেত্রীরা তাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছেন। রাজনীতির যখন ভয়াবহ দুর্দিন, রাজনীতিকে যখন গিলে ফেলছে কালো টাকার মালিক, ব্যবসায়ী, সামরিক ও বেসামরিক আমলারা, জনতার শক্তির প্রতীক আইভীর বিজয় তখন আমাদের কাছে শুভ বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.