শিশুমন-সমস্যার নাম ‘ডোরেমন’ by নাইর ইকবাল

বাংলাদেশের একটি প্রজন্ম মাতৃভাষা ভুলে যাচ্ছে। অবতরণিকাটি কি একটু নাটকীয় কিংবা আবেগাশ্রয়ী হয়ে যাচ্ছে? হলে হোক, চোখের সামনে যা দেখছি, তার সঙ্গে অবতরণিকার খুব একটা পার্থক্য নেই। এখানে পুরো ব্যাপারটিকে কেউ আবেগাশ্রয়ী বললেও কিছু যায়-আসে না।


এমনিতেই জাতিগতভাবে আমাদের জাত্যভিমান একটু কম। কোনো ভারতীয় বা পাকিস্তানি নাগরিক আমাদের সঙ্গে হিন্দি কিংবা উর্দুতে কথা বললে আমরা অভিভূত হই। আনন্দের আতিশয্যে আমরাও তাদের সঙ্গে হিন্দি বা উর্দুতে কথা বলার অপচেষ্টা চালাতে থাকি। সেই দেশের একটি প্রজন্ম যদি সবাই হিন্দিতে ডাবিং করা একটি কার্টুন সিরিয়ালে অতিমাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে যথেষ্ট আবেগ আশ্রয় করেই চিন্তিত হচ্ছি বৈকি!
ব্যাপারটি অনেকেই ধরতে পেরেছেন আশা করি। কেবল টেলিভিশনে অজস্র চ্যানেলের ভিড়ে ‘ডিজনি’ নামের একটি চ্যানেলে ‘ডোরেমন’ নামের একটি জাপানি কার্টুন সিরিয়াল হিন্দিতে ভাষান্তরিত করে দেখানো হয়। বলতে গেলে প্রায় দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা। এই কার্টুনটি বাচ্চাদের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয় যে ধীরে ধীরে এটি প্রায় প্রত্যেক মা-বাবারই কপালে চিন্তার বলিরেখা তৈরি করেছে। এই কার্টুনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি, তাঁদের ছেলেমেয়েদের না আবার মাতৃভাষা ভুলিয়ে দেয়। এরই মধ্যে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, এমন কোনো বাড়ি এখন আর অবশিষ্ট নেই, যেখানে বাচ্চা ছেলেমেয়ে আছে কিন্তু তারা ডোরেমন দেখে না। কেবল দেখলেও একটা কথা ছিল। বাচ্চারা নাকি এই সিরিয়ালের বিভিন্ন চরিত্রকে হুবহু নকলের বিপজ্জনক চেষ্টায় লিপ্ত।
সেদিন নিজের চোখে ‘ভয়ংকর’ একটি ব্যাপার দেখে রীতিমতো প্রমাদ গুনেছি। আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। সদ্যই স্কুলে যেতে শুরু করা বাড়ির ছোট ছেলেটি রীতিমতো ঘোরের মধ্যে থেকে ডোরেমন দেখছে এবং তার মা যা যা জিজ্ঞেস করছেন, তাতে সে উত্তর দিচ্ছে পরিষ্কার হিন্দিতে। বাচ্চাটিকে আমি জন্মাতে দেখেছি, মুখে কথা ফোটাও আমার সামনেই ঘটেছে। সে যখন বাংলার চেয়ে পরিষ্কার স্বরে হিন্দি বলে—আমার আতঙ্কিত হওয়ার ব্যাপার এখানেই।
কার্টুন ছোটদের কাছে খুব মজার একটি বিষয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই। শিশুর মনোজগতে কার্টুন সিরিয়ালের প্রভাব খুবই সুদূরপ্রসারী—ভয়ের ব্যাপারটি এখানেই। আমাদের প্রজন্ম বিটিভিতে প্রচারিত বেশ কিছু জনপ্রিয় কার্টুন সিরিয়ালে আসক্ত ছিল। দেশের জাতীয় টেলিভিশন নেটওয়ার্কে প্রচারিত হওয়ার কারণে আমাদের ছোটবেলায় প্রচারিত কার্টুনগুলো ছিল অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত ও সম্পাদিত। সবচেয়ে বড় কথা, সেই কার্টুনগুলো ইংরেজি ভাষায় প্রচারিত হওয়ায় এর অপকারের চেয়ে উপকারের পরিমাণটি ছিল অনেক বেশি।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ডোরেমন কার্টুনটির ক্ষেত্রে বিপদের মাত্রা অনেক বেশি। প্রথমত, এই কার্টুনটি হিন্দি ভাষায় ভাষান্তরিত। এই কার্টুনের নেশা খুব কচি বয়সেই শিশুদের অন্য একটি ভাষা রপ্ত করিয়ে দিচ্ছে, যা নিজেদের সংস্কৃতির জন্য খুব বড় ধরনের একটি হুমকি। নিজের ভাষা ঠিকমতো রপ্ত করার আগেই যদি তারা অন্য একটি অপ্রয়োজনীয় ভাষায় কথা বলতে শেখে, সেটা দেশের ভবিষ্যৎ সাংস্কৃতিক মনন তৈরি হওয়ার পথে একধরনের প্রতিবন্ধকতা। দ্বিতীয়ত, কার্টুনটিতে এমন কিছু কাহিনি দেখানো হয়, যেগুলোকে আমাদের সংস্কৃতিতে খারাপ চোখে দেখা হয়। যেটা শিশুর আদর্শিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
ডোরেমন কার্টুনের একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র নাকি মায়ের সঙ্গে প্রায়ই মিথ্যে কথা বলে। এটা আমি জানতে পারি আমারই এক বন্ধুর কাছে। সে এই প্রসঙ্গে আমাকে জানায়, ওর মেয়ের স্কুলে এক অভিভাবক নাকি এ ধরনের একটি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। ওই অভিভাবকের শিশুসন্তান পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়ে বাসায় খাতা দেখায়নি। ব্যাপারটি ধরা পড়ে গেলে সেই অভিভাবক বাচ্চার কাছে জানতে চান, মিথ্যে বলা সে কোথা থেকে শিখেছে। উত্তরে অবাক করে দিয়ে শিশুটি বলে, ডোরেমন কার্টুনের নবিতার কাছ থেকে সে এটা শিখেছে। কার্টুন যদি বাচ্চাকে মিথ্যে বলা শেখায়, তবে তা সত্যিই আশঙ্কার বিষয়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এত সব আশঙ্কা, অভিযোগ, অনুযোগের সমাধান কী? আপনার বাচ্চা হিন্দি শিখে যাচ্ছে, অপসংস্কৃতি রপ্ত করে ফেলছে, এই আশঙ্কায় তাকে কি ডোরেমন দেখতে দেবেন না? অনেক মা-বাবা হয়তো তা-ই করছেন বা করবেন, কিন্তু সত্যিকার অর্থে সেটা কি সমস্যার সমাধান? অবশ্যই নয়। সমাধান হচ্ছে এর বিকল্প খুঁজে বের করা। নিদেনপক্ষে, ‘হিন্দি’ ডোরেমনের হাত থেকে শিশুদের রক্ষা করা। ডোরেমন কার্টুনের জনপ্রিয়তা অনুধাবন করে আমাদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি কিংবা অন্যান্য বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল কি পারে না এই কার্টুনটি আমদানি করে বাংলায় ডাবিং করে তা প্রচার করতে? ব্যাপারটি ভেবে দেখার বোধ হয় এখনই সময়। নয়তো সর্বনাশের আর বাকি থাকবে না।
নাইর ইকবাল: সাংবাদিক।
nayirdhaka@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.