প্রবাস থেকে-হুইপের সভায় কুকুর বনাম ইমেজ সংকট by ফারুক যোশী

বাংলাদেশের দল এবং দলীয় কোন্দল দেশ ছেড়ে বিদেশে। লন্ডনে-নিউইয়র্কে। ব্রিটেনের প্রায় প্রতিটি শহরেই এই কোন্দল যেন একটা নিত্যদিনের ব্যাপার। বাঙালি অধ্যুষিত বড় বড় শহর লন্ডন-ম্যানচেস্টার-বার্মিংহাম-ওল্ডহ্যামসহ ছোট শহরগুলোর প্রতিটিতেই দুটি বড় দলের আছে নির্বাহী কমিটি বাংলাদেশের সরকারবিরোধী আন্দোলনে একটা গতি নিয়ে আসায় চেষ্টারত বিএনপি। এই শীতে বিভিন্নভাবেই কর্মীদের সচল-সরব রাখতে উদ্যোগ আছে বিএনপির। বিভিন্ন ইস্যু,


যেমন_ কখনও টিপাইমুখ, কখনও ঢাকা বিভক্তি, কখনও গুপ্তহত্যা কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ_ সব ক্ষেত্রেই হয়েছে কমবেশি লাঠালাঠি, চুলোচুলি। কিন্তু সবকিছু উতরে গেছে সিলেটে বাসে আগুন ধরিয়ে এক মহিলার নির্মম মৃত্যু। এ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের বঙ্গীয় রাজনীতিতে আবারও প্রমাণিত হলো_ রাজনীতি মানে হত্যা নিয়ে নাড়াচাড়া। হত্যা-সন্ত্রাস না হলে রাজনীতিতে নতুন মাত্রা আসে না। কাভারেজ আসে না। তাই তো একেকটা মৃত্যুকে রাজনৈতিক মৃত্যু হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার কী অদ্ভুত প্রতিযোগিতা থাকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকায় ককটেল বিস্ফোরণে তরুণ আরিফুুজ্জামানের মৃত্যু নিয়েও সেই একই কথা। পরিবার বলে, ছেলে রাজনীতির সঙ্গে নেই আর বিএনপি বলে তাদের কর্মী। সবকিছুর মধ্যেই আছে রাজনীতির গন্ধ; দু'দলের সহিংসতা, দলীয় কোন্দল, অভ্যন্তরীণ মারামারি আর সেই চুলোচুলি। বিএনপির গত রোডমার্চের সময় আমরা দেখেছি সিলেটে ইলিয়াস-মকবুল দ্বন্দ্ব; চেয়ারে বসার মূল্য কীভাবে ২০ লাখ টাকায় পেঁৗছেছিল এবং কীভাবে পরে তা মিডিয়া ফোকাস হয়ে দু'জনের চুলোচুলির খবর চাউর হয়ে যায় দেশব্যাপী। দ্বন্দ্ব আছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে, সব দলেই। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এটা কোনো অশুভ ইঙ্গিতও নয়। ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত দুই ভাইয়ের লড়াইয়ে একসময়ের ব্রিটেনের মন্ত্রীকে হারিয়ে তার ছোট ভাই এড মিলিবার্ন এখন পার্টির নেতৃত্বে।
২. বাংলাদেশের দল এবং দলীয় কোন্দল দেশ ছেড়ে বিদেশে। লন্ডনে-নিউইয়র্কে। ব্রিটেনের প্রায় প্রতিটি শহরেই এই কোন্দল যেন একটা নিত্যদিনের ব্যাপার। বাঙালি অধ্যুষিত বড় বড় শহর লন্ডন-ম্যানচেস্টার-বার্মিংহাম-ওল্ডহ্যামসহ ছোট শহরগুলোর প্রতিটিতেই দুটি বড় দলের আছে নির্বাহী কমিটি। দলীয় অনুমোদন নিয়েই এগুলো কাজ করে। অন্যদিকে ওই কমিটিতেই আসীন নেতাকর্মীদের আছে আবার নিজস্ব গ্রুপ। সভা-সমাবেশে এ গ্রুপগুলো বক্তৃতা নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেয়, হয় রক্তক্ষয়ী অভ্যন্তরীণ লড়াই। লড়াইটা হোক এতে আমাদের খুব একটা ক্ষতি নেই। সাধারণ বাঙালিদের এতে যায় আসে না। কিন্তু তখনই কথা ওঠে, যখন ওই কোন্দলের রাজনীতি সহিংসতায় রূপ নেয়। সহিংসতায় রূপ নেওয়া মানেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জড়িয়ে পড়া। থানা-আদালত দৌড়াদৌড়ি। এরকমই একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে এ বছরেরই প্রথম দিকে, হয়েছে লর্ডে আওয়ামী লীগ-বিএনপির চেয়ার ছোড়াছোড়ি। মন্ত্রী-সাবেক মন্ত্রীদের সভার মাঝখানে রেখেই লর্ডে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনাটি শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়, তাও শুধু কার নেতা মঞ্চে উঠবেন এই নিয়ে। যদিও শেষ পর্যন্ত দু'জন কর্মীর সাজাভোগের মধ্য দিয়ে এ নাটকটির যবনিকা ঘটেছিল।
ঠিক এভাবেই ঘটেছে আরেকটি ঘটনা। এবার বিএনপির ভেতরেই সংঘটিত হয়েছে তা। গত ১২ ডিসেম্বর সংগঠনটি এক সভার আয়োজন করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ওপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, টিপাইমুখ ইস্যু, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ও ঢাকা বিভক্তিকরণের প্রতিবাদে পূর্ব লন্ডনে এ সভার আয়োজন করে যুক্তরাজ্য বিএনপি। এ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। যথারীতি সভা শুরু হয়। কিন্তু বক্তৃতা দেওয়া নিয়ে শুরু হয়ে যায় পুরনো সব কাণ্ড। দুই গ্রুপের একটির নেতা বক্তৃতার জন্য দাঁড়ানোর জায়গা না পেলে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তার অনুসারীরা অমুক ভাই অমুক ভাই (সাবেক সাধারণ সম্পাদক) বলে বলেই সভাটি পণ্ড করতে থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত জয়নুল আবদিন ফারুক আর বলতেই পারেননি সরকারবিরোধী কথাগুলো। বলতে পারেননি সারাদেশেই চলছে তাদের বক্তৃতার ভাষার আওয়ামী দুঃশাসন। দুঃশাসনের কথা তো বলতেই পারেননি, বরং তার দলের কর্মীরাই পুলিশ ডাকে। বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কায় কুকুর নিয়ে আসে পুলিশ, মানুষের সন্ধান করতে এই সভায়। বিএনপির দু'পক্ষের এ রকম পাল্টাপাল্টি অনেক বছরের পুরনো। বিএনপির প্রয়াত সভাপতি কমর উদ্দিন ছিলেন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত তারেক রহমানের খুবই ঘনিষ্ঠজন। সে জন্যই কমর উদ্দিন তাকে খুব সহজেই সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ওই নেতা বিএনপি লিমিটেড কোম্পানি করে বিএনপি নামটি তার নিজস্ব করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মূলস্রোতের কাছে স্বাভাবিকভাবেই পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু কমর উদ্দিনের আকস্মিক মৃত্যু তাকে বিএনপির কাছে আসতে সহায়তা করে। তারেক রহমানের অনুকম্পাও কিছুটা পান। কারণ তারেক রহমান চেয়েছেন ব্রিটেনে একটা শক্তিশালী বিএনপি গড়ে তুলতে। কিন্তু পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে তারেক রহমানের সেই অনুকম্পা কি আর আছে? তাই তো আবারও সন্ত্রাস-মারামারি শুরু হয়েছে যুক্তরাজ্যের বিএনপিতে। ইতিমধ্যে বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বও সংবাদ সম্মেলন করে বলে দিয়েছে_ যারা সন্ত্রাস করেছে, তারা বিএনপির অপশক্তি এবং সরকারের দালাল। এভাবেই একের পর এক ঘটনা এই ব্রিটেনে ভিনদেশিদের কাছে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে নতুন পরিচয়ে। ভিন্ন ভিন্ন সময় বাংলাদেশি রাজনীতির নাম নিয়ে দু'দলের কর্মীরা সহিংস ঘটনার জন্ম দেয়। সময়ে-অসময়ে দুটি দলই তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রয়োজনে কখনও পার্লামেন্টের সামনে কখনও বা ডাউনিং স্ট্রিটে বিক্ষোভ দেখায়। যে দলই ক্ষমতায় আসে, তার বিরোধী দলটি প্রতিবারই এ কাজটি করে। অর্থাৎ এটা যেন রাজনীতির এক সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির। তারা কোনো না কোনোভাবে সরকারের বিরোধিতা করে ধরনা দেয় এই পার্লামেন্ট কিংবা ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে। অর্থাৎ তারা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের একটা ব্যর্থতাই তুলে ধরার তৎপরতা চালায়। এর ফলে কোনোভাবেই ব্রিটেনে আমাদের পজিটিভ দিক ফুটে উঠছে না। সৃষ্টি হচ্ছে গোটা বাংলাদেশের ইমেজ সংকট।
৩. সে কারণেই কি ব্রিটেনের বাঙালিদের পাশাপাশি ইংরেজিভাষী জনগণকে দেখতে হচ্ছে ১২ পাতার বিজ্ঞাপন? ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিকে যেন পাঠক মুখ (ছবি) দেখছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী কিংবা লন্ডনে হাইকমিশনারের। কী এমন প্রয়োজন কোটি টাকা খরচ করে ইমেজ সংকট সমাধানের? বিজ্ঞাপনে ব্যবসা হয়, ইমেজ সংকট সমাধান হয় না। বিশেষত একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে এই বিজ্ঞাপন কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, দেড় কোটি টাকা খসে গেছে রাষ্ট্রের। একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখ করতে চাই, ব্রিটেনের সব জায়গায় কিন্তু এই ক্রোড়পত্রটি পাওয়াও যায়নি। কিছু অঞ্চলের দ্য টাইমসে ছাপা হয়েছে এভাবে যে, বাংলাদেশ নিয়ে একটি ক্রোড়পত্র আছে ঠিকই তবে তা ওয়েবসাইটে দেখার জন্য বলা হয়েছে। ম্যানচেস্টারে অনেক খোঁজাখুঁজি করে আমরা টাইমসে পাইনি এই ১২ পাতার প্রচার। অথচ ম্যানচেস্টার-ওল্ডহ্যাম-হাইড-লিভারপুল তথা নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডে কম করে হলেও পঞ্চাশ হাজার বাঙালি বসবাস করে। এমনকি ম্যানচেস্টারকে ব্রিটেনের দ্বিতীয় শহর হিসেবেও মনে করা হয়। অথচ এই অঞ্চলের টাইমসে এই বিজ্ঞাপন পায়নি মানুষ। দেখা গেছে শুধু একটি ওয়েবসাইটের ঠিকানা। তাহলে কী ধরনের বিজ্ঞাপন হয়েছে এটা? নাকি এখানেও বাণিজ্য হয়েছে?
৪. আমরা দেখছি কী ঘটছে দেশে দেশে, বিশেষত পশ্চিমের দেশগুলোতে। দলবাজি করতে গিয়ে কী করছে তারা। এই ব্রিটেনে আছে বাঙালিদের অনেক প্রাপ্তি, মূলধারার রাজনীতিতে। এমপি-নির্বাহী মেয়র-কাউন্সিলর, পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায় আছে অনেক চোখ ধাঁধানো সফলতা। অথচ সময়ে সময়ে এসব ম্লান করছেন ওই সব দলবাজ রাজনীতিবিদ। দলবাজ রাজনীতিবিদদের কারণেই বাংলাদেশের এই ইমেজ সংকট ব্রিটেনে। এই ইমেজ সংকট কি কোটি টাকায় ফিরে আসবে_ সে প্রশ্ন থেকেই যায়।


ফারুক যোশী : যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক
faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.